ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে তৃতীয় দফার আলোচনার প্রাক্কালে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চীন সফর বিশ্ব কূটনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই সফর শুধু একটি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার অংশ নয়, বরং স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়- ইরান পারমাণবিক আলোচনায় রাশিয়া ও চীনকে পাশ কাটিয়ে একক সিদ্ধান্তে যেতে প্রস্তুত নয়।
চলমান উত্তেজনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনা শুরু হয়েছে ওমানের মাধ্যমে। তবে, এই আলোচনা সরাসরি নয়- দুই পক্ষ পৃথক কক্ষে বসে ওমানি মধ্যস্থতায় বার্তা আদান-প্রদান করছে। এই পরিস্থিতিতে আরাকচির চীন সফর এবং তার আগের রাশিয়া সফর ইঙ্গিত দেয়, ইরান আন্তর্জাতিক আলোচনায় একা কোনো সিদ্ধান্তে যেতে চায় না এবং কৌশলগতভাবে মিত্র দেশগুলোর মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
এর আগে ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সরে যাওয়ার পর থেকেই ইরান পশ্চিমাদের ওপর অবিশ্বাসী। ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পুনরাবির্ভাব এবং তার ইরানবিরোধী অবস্থান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র আবারও কৌশলগতভাবে সামরিক চাপ সৃষ্টি করছে- মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় পরমাণু বোমারু বিমান পাঠিয়ে ওয়াশিংটন বোঝাতে চাচ্ছে, তারা শুধু আলোচনা নয়, প্রয়োজনে ‘বিকল্প পথ’ বেছে নিতেও প্রস্তুত।
অপরদিকে রাশিয়া ও চীন শুধু ইরানের অর্থনৈতিক ও সামরিক মিত্র নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ইরানের একমাত্র ভরসাযোগ্য অংশীদার। এ বিষয়ে মস্কো সফরের সময়ে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট বলেন, পারমাণবিক ইস্যুতে তেহরান সব সময় রাশিয়া-চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরামর্শ করে। সম্প্রতি ইরানের চীন সফরের উদ্দেশ্যও মূলত আমেরিকার সঙ্গে আলোচনার আগে বেইজিংয়ের মতামত নেওয়া।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া-চীনের পরাশক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ ইরানকে যেমন কূটনৈতিক বল দিয়েছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রকেও বার্তা দিচ্ছে- তারা যেন বিষয়টিকে ‘ইরান বনাম যুক্তরাষ্ট্র’ হিসেবে না দেখে। চীন যেমন ইরানের তেল অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে, তেমনি রাশিয়া ইরানের পরমাণু চুক্তিতে কৌশলগত সহায়তা করে যাচ্ছে। এই দুই শক্তিকে পাশ কাটিয়ে ইরান এককভাবে কোনো পদক্ষেপ নেবে, এমনটা ভাবা বাস্তবতাবিরোধী।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্র অতীতে যেমন লিবিয়া, ইরাক কিংবা আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে একদিকে শান্তির বার্তা, অন্যদিকে সামরিক হুমকি দিয়ে কাজ হাসিল করেছে, এবারও সেই পুরোনো ছকের পুনরাবৃত্তি করতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে- এই কৌশল এখন কতটা কার্যকর? কারণ, ইরান এখন সেই ২০১৫ সালের ইরান নয়। এখন তাদের পাশে চীন-রাশিয়ার মতো কৌশলগত জোট আছে।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি ও সাম্প্রতিক ইসরায়েল-সিরিয়া ঘাঁটিতে অস্ত্র সরবরাহের খবরে এটা স্পষ্ট যে, ওয়াশিংটন চাপের কূটনীতির পথেই হাঁটছে। তারা ইরানকে আলোচনার টেবিলে ‘নরম’ করার চেষ্টা করছে, আর ইরান রাশিয়া-চীনের সহযোগিতা নিয়ে কূটনৈতিক জবাব দিতে চাইছে।
তবে মার্কিন বৈঠক নিয়ে ইরানের অভ্যন্তরেও এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে। ইরানের ক্ষমতাসীনদের একটি অংশ এই আলোচনাকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘চাল’ হিসেবে দেখছে। তারা সাবেক লিবিয়ান নেতা গাদ্দাফির পরিণতির উদাহরণ টেনে বলছে, পশ্চিমাদের সঙ্গে সমঝোতা শেষ পর্যন্ত ধ্বংস ডেকে আনে। এই অভ্যন্তরীণ চাপ ইরান সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে এই বৈঠক ইঙ্গিত করছে- ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করলেও রাশিয়া ও চীনের মতামত ছাড়া এককভাবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে যেতে চায় না। এই জোট কেবল একটি কূটনৈতিক কৌশল নয়, বরং ইরানের জন্য রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত আত্মরক্ষার রক্ষাকবচ।
তাই প্রশ্নটা এখন আর শুধু ইরান-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব নয়, বরং বৃহত্তর শক্তির ভারসাম্যে কে কাকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে, সেটাই মূল বিষয়। আর এই ভারসাম্যে রাশিয়া ও চীনের ভূমিকা যতদিন না বোঝা যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত ইরানও একক সিদ্ধান্তে যাবে না- এটা নিশ্চিত।
মন্তব্য করুন