পাপলু রহমান
প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০২:২৩ পিএম
আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:০৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
বিশ্লেষণ

যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল মিলে কী ঘটাতে চলেছে

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এক দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাসে গড়া। ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে অশান্তি শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে এ সম্পর্ক কখনো উত্তপ্ত, কখনো শীতল থেকেছে। কিন্তু সম্প্রতি ট্রাম্প ক্ষমতায় আসায় এই সম্পর্ক আরও বেশি উত্তপ্ত হয়েছে এবং বর্তমানে তা এক মারাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ সম্পর্কের বর্তমান পরিস্থিতি ও তার সম্ভাব্য ফলাফলের বিশ্লেষণ নিয়ে এই প্রতিবেদন।

ইরানের পরমাণু কার্যক্রম

ইরান অনেক দিন ধরেই দাবি করে আসছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে। কিন্তু অন্যান্য দেশ বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরায়েল, ইরানের পরমাণু কর্মকাণ্ড নিয়ে উদ্বিগ্ন। ২০১৫ সালে ইরান ও ছয় বিশ্বশক্তি—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া ও চীন একটি ঐতিহাসিক পরমাণু চুক্তি (জেসিপিওএ) সই করে। এ চুক্তি অনুযায়ী ইরান পরমাণু কর্মসূচি সীমাবদ্ধ করবে এবং আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের কাছে তার পরমাণু স্থাপনাগুলো খোলামেলা রাখবে, বিনিময়ে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন, একইসঙ্গে দাবি করেন, চুক্তিটি ইরানকে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন করতে উৎসাহিত করছে এবং ইরান কখনোই পরমাণু অস্ত্র বানানো থেকে বিরত থাকবে না।

পরে ইরান তার পারমাণবিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করে এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেয়। এ ইউরেনিয়াম পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে ইরান ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার জন্য যথেষ্ট।

ট্রাম্পের ‘সর্বাধিক চাপ’ কৌশল

চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পর, ট্রাম্প ইরানের ওপর ‘সর্বাধিক চাপ’ কৌশল অবলম্বন করেন। ইরানকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এ কৌশলের লক্ষ্য ছিল ইরানকে আলোচনায় নিয়ে আসা এবং তাদের পরমাণু কার্যক্রম সীমিত করতে বাধ্য করা। তবে ইরান চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করতে শুরু করে এবং অধিক ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে। এ সময় মার্কিন প্রশাসন ইরানকে পরমাণু কর্মসূচি সম্পূর্ণ বন্ধ করতে এবং সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করতে চাপ তৈরি করে।

ইরানের প্রতিক্রিয়া

ইরান অবশ্য এই চাপকে এড়িয়ে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান বলছে, পরমাণু অস্ত্র তৈরির ইচ্ছা তাদের নেই, তবে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার তারা করতেই পারে। ইরানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল তাদের পরমাণু স্থাপনায় আক্রমণ করে, তবে ইরান বাধ্য হয়ে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে। ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীরা এখন অনেক বেশি দক্ষ এবং তারা সহজেই পরমাণু অস্ত্র তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে জানেন। ফলে যদি যুদ্ধ শুরু হয়, ইরান পরমাণু সক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে এবং বিশ্বকে পরমাণু ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।

সামরিক নাকি কূটনৈতিক পদক্ষেপ

বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একদিকে ইরানকে আরও বেশি চাপ দিতে চাইছেন, অন্যদিকে তিনি কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান করতে চান। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির কাছে একটি চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে তিনি সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে বলেন, পরমাণু নিয়ে সমঝোতা যদি না হয়, তবে ইরানকে সামরিক পদক্ষেপের মুখোমুখি হতে হবে। ইরান অবশ্য এই প্রস্তাবের প্রতি খুবই সন্দিহান। কারণ তারা মনে করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এমন পরিস্থিতিতে ইরান আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিশ্বাসের জায়গা নেই।

ইসরায়েল ও যুদ্ধের সম্ভাবনা

ইসরায়েল এ সংকটের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পরমাণু অস্ত্রের হুমকি থেকে মুক্তির জন্য ইরানকে অবশ্যই পরমাণু কর্মসূচি পরিত্যাগ করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি ইরানকে ‘লিবিয়ার মডেল’ অনুসরণ করার পরামর্শ দেন, যেখানে লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি ২০০৩ সালে পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবে ইরান এই মডেল মেনে চলবে না, কারণ তাদের জন্য পরমাণু শক্তি হলো গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা উপাদান।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি আলোচনা ব্যর্থ হয় এবং সংকট ঘনীভূত হয়, ইসরায়েল ও আমেরিকা সম্ভবত যৌথভাবে ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক হামলা চালানোর পরিকল্পনা করতে পারে। তবে এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, কারণ ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো অনেক গভীর গর্তে সুরক্ষিত, যা একক বিমান হামলায় ধ্বংস করা কঠিন। এ কারণে ইসরায়েলকে বিশেষ বাহিনী বা মার্কিন বিশেষ বাহিনীর সহযোগিতা প্রয়োজন হতে পারে।

যুদ্ধের বিপক্ষে মার্কিনিরা

মার্কিন জনগণের মধ্যে একটি বৃহৎ অংশ এই সামরিক উত্তেজনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে, কনজারভেটিভ, প্রোগ্রেসিভ ও লিবারটেরিয়ান ব্যক্তিত্বরা এ সংকটকে ‘নিজের মৃত্যু ডেকে আনা’ হিসেবে বিবেচনা করছেন। তারা মনে করেন, যুদ্ধ শুরু হলে এটি শুধু আমেরিকান জীবন ও অর্থনীতি ধ্বংস করবে না, বরং পশ্চিম এশিয়ার ওপরও বিপর্যয়ের ছায়া ফেলবে। সাংবাদিক টাকার কার্লসন বলেছেন, ‘ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ আমাদের জন্য আত্মঘাতী হবে, হাজার হাজার আমেরিকান প্রাণ হারাবে।’

এ ছাড়া প্রোগ্রেসিভ গ্রুপ কোডপিংকও যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা দাবি করছে, যুদ্ধের ফলে শুধু ইসরায়েলের লাভ হবে, আমেরিকার নয়।

সামরিক ব্যবস্থার প্রস্তুতি

বিপুল পরিমাণ ক্ষতি ও বিপর্যয়ের মধ্যেও বর্তমানে ট্রাম্প প্রশাসন একটি কূটনৈতিক সমাধান খুঁজছে, তবে তাদের শর্তগুলো ইরানের জন্য কঠিন হতে পারে। এর পাশাপাশি, মার্কিন প্রশাসন ইসরায়েলকে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং আরও যুদ্ধবিমান সরবরাহ করছে। এতে এটা বোঝায়, তারা সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে প্রস্তুত হচ্ছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, পরমাণু আলোচনা বা চুক্তি না হলে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। তিনি আরও বলেছেন, পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে কোনো চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য ‘খুব বেশি সময় নেই।’

শুধু তাই নয়, তিনি ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে নেতৃত্ব দিতে চান। সামরিক পদক্ষেপের বিকল্প আছে কিনা জানতে চাইলে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, অবশ্যই আছে। যদি সামরিক পদক্ষেপের প্রয়োজন হয় তাহলে আমরা সামরিক ব্যবস্থা নেব। আর ইসরায়েল এই পদক্ষেপে নেতৃত্ব দেবে।

শেষ কথা

ইরান-আমেরিকা সম্পর্কের ভবিষ্যৎ খুবই অনিশ্চিত এবং একে খোলামেলা কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা কঠিন। যদি ট্রাম্প সফলভাবে ইরানকে আলোচনায় নিয়ে আসেন, তা হলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হতে পারে, কিন্তু যুদ্ধের ঝুঁকি রয়ে গেছে। অতীতে যেমন ইরাক যুদ্ধের পরিণতি ভয়াবহ ছিল, তেমনি ইরানের সঙ্গে কোনো সামরিক সংঘাতের ফলও একই হতে পারে। এর ফলে কূটনৈতিক সমাধানই এই সংকটের একমাত্র পথ হতে পারে, যা বিশ্বের জন্য মঙ্গলজনক।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমরা সবাই এক পরিবারের সদস্য : প্রধান উপদেষ্টা

আহতদের চিকিৎসা দিতে ফিলিস্তিন যেতে চান সিলেটের নার্সরা

বাংলাদেশে প্রথম ‘হার্ভার্ড HSIL হ্যাকাথন ২০২৫’ ইউআইইউ’তে অনুষ্ঠিত

নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ছাত্রদলের জরুরি নির্দেশনা

মা-বাবার কাছে যেতে চায় আরাধ্য

‘আমাকে ছাড়িয়ে নিন’, ভিডিওতে ইসরায়েলি জিম্মির আবেদন

ইয়েমেনে জড়ো হচ্ছে হাজার হাজার সৈন্য

বেরোবিতে শিক্ষকদের হাজিরা শিটে মুজিববর্ষের লোগো

সামিটে ৩১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে : বিডা চেয়ারম্যান

খোলামেলা নাচে বিপাকে মাহি

১০

স্ট্যান্ড দখল নিয়ে ফের দুগ্রুপের সংঘর্ষ, বিএনপি নেতা গুলিবিদ্ধ

১১

বিগত সরকার নববর্ষকে এককেন্দ্রিক করে ফেলেছিল : রিজভী

১২

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটি : কাকে ঠেকাতে, কাকে রক্ষায়?

১৩

‘সামিটে সরকারের খরচ ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা’

১৪

মহিষ লুট করে বিএনপির ১১ নেতাকর্মী কারাগারে

১৫

বিদেশি অনুষ্ঠানে সবার নজর কাড়লেন সিরিয়ার ফার্স্ট লেডি

১৬

ডাক বিভাগে সেবার মান বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ শুরু

১৭

নরসিংদীতে চাঁদা না পেয়ে শ্রমিক দল নেতার বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীকে মারধরের অভিযোগ

১৮

প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চমকপ্রদ সাফল্য

১৯

পতিত স্বৈরাচারের ষড়যন্ত্র মানুষ মেনে নেবে না : দুলু

২০
X