ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান উত্তেজনা এবং পরমাণু কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা চরম অবস্থায় রয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান পরমাণু ইস্যুতে আলোচনায় বসতে চলেছে। কিন্তু ইরান এ আলোচনার প্রস্তাবকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে, তবে তারা পরোক্ষ সংলাপ চালিয়ে যেতে রাজি। এটি যেন এক যুদ্ধের ইঙ্গিত।
ইরান যেহেতু পরোক্ষ আলোচনায় যেতে চায়, এটি বলা য়ায় যে তারা যুদ্ধের পথে হাঁটতে চায় না। তবে যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করলে এর জবাব দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত তারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি, ইরানের পরমাণু আলোচনার সম্ভাবনা ও ইরানের কঠোর অবস্থান নিয়ে সাজানো হয়েছে এ প্রতিবেদন।
ইরানের শক্তি ও দৃঢ়তা
ইরান (প্রাচীন পারস্য) বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর একটি। এ দেশের ইতিহাস হাজার হাজার বছরের পুরনো। ইরানিরা শতাব্দী ধরে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের আক্রমণ সত্ত্বেও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করেছে। একাধিক মঙ্গোল, রোমান, তুর্কি, ব্রিটিশ ও আরব আক্রমণের পরেও ইরান কখনো পুরোপুরি পরাজিত হয়নি। সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে ইরাক ইরানের বিরুদ্ধে আট বছর ধরে যুদ্ধ করেছিল, কিন্তু ইরান সে যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিল। এটি প্রমাণ করে, ইরান যে কোনো শক্তির মোকাবিলা করতে সক্ষম। তবে, এই শক্তি কোথায় নিহিত? এটি শুধু সামরিক শক্তিতেই সীমাবদ্ধ নয়। ইরানের সরকারের দৃঢ়তা এবং সুশৃঙ্খল নীতির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ট্রাম্পের হুমকি : পরমাণু বোমা এবং যুদ্ধের শঙ্কা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে চূড়ান্ত হুমকি দিয়েছেন। ট্রাম্প বলেছেন, ইরান যদি পরমাণু চুক্তিতে রাজি না হয়, তবে তারা এমন এক বোমা হামলার শিকার হবে যা তারা কখনো কল্পনা করেনি। ট্রাম্পের এমন কথা শুধু ইরান নয়, বিশ্বকে তোলপাড় করেছে। ট্রাম্পের কথায়, ইরান যদি চুক্তি না করে, তবে তাদের ওপর মারাত্মক হামলা হবে। এর মানে হলো, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পরমাণু প্রকল্পকে থামাতে ইরানকে ভয় দেখাচ্ছে এবং এর মাধ্যমে তারা একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অন্যদিকে, ইরান কখনোই পরমাণু বোমা তৈরি করার কথা অস্বীকার করেনি। তারা দাবি করছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি শান্তির উদ্দেশ্যে এবং তাদের কোনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা নেই। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল, তাদের এ দাবিকে সন্দেহের চোখে দেখে। তাদের মতে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাইছে এবং এ কারণে ইরানকে পারমাণবিক শক্তির বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপে পড়তে হচ্ছে।
পরমাণু ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি
যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। মার্কিন প্রশাসন বারবার বলেছে, তারা ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেবে না। মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্য ও নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এ অবস্থান নিয়েছে। কারণ, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে, তাহলে এটি গোটা অঞ্চলের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তাই যুক্তরাষ্ট্র এ নিয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে এবং ইরানকে শান্তিপূর্ণভাবে পরমাণু কর্মসূচি পরিচালনা করার জন্য চাপ দিচ্ছে।
২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও বড় কয়েকটি দেশ ইরানের সঙ্গে একটি পরমাণু চুক্তি (জেসিপিওএ) সই করেছিল। চুক্তিতে ইরান তার পরমাণু কর্মসূচিকে সীমিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং বিনিময়ে ইরানকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন একতরফাভাবে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায় এবং ইরানের ওপর আবার নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়। এরপর থেকে ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়, যার ফলে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
ইরান ঘিরে উত্তেজনা
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়েদ আলি খামিনি সম্প্রতি ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, তুরস্ক এবং বাহরাইনকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, যদি এই দেশগুলো মার্কিন সামরিক অভিযানে সহায়তা করে, তাহলে তাদের জন্য গুরুতর পরিণতি অপেক্ষা করছে। এসব দেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের আকাশসীমা বা ভূখণ্ড ব্যবহারের অনুমতি দিলে কঠোর পদক্ষেপ নেবে ইরান। এতে মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও তীব্র হয়ে উঠছে। বিশেষ করে, আমেরিকা এবং ইরানের মধ্যে এ উত্তেজনা সারা পৃথিবীকে প্রভাবিত করতে পারে, কারণ বিশ্বের জ্বালানি তেল সরবরাহের জন্য মধ্যপ্রাচ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল।
পরমাণু আলোচনার সম্ভাবনা
এখন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে নতুন করে পরমাণু আলোচনার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। ট্রাম্প দাবি করছেন, ইরান যদি পরমাণু চুক্তিতে ফিরে আসে, তাহলে তারা একটি ‘বড় চুক্তি’ করতে সক্ষম হবে। চুক্তি করতে ব্যর্থ হলে ইরানকে মহাবিপদে পড়তে হবে—ট্রাম্প এমন হুমকিও দিয়েছেন। তবে ইরান সরাসরি আলোচনার হুমকি প্রত্যাখ্যান করেছে এবং পরোক্ষ আলোচনার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা চাপ ও হুমকি উপেক্ষা করেছে। তেহরান জানিয়েছে, ইরান কখনোই জোরজবরদস্তি মেনে নেবে না। তারা তৃতীয়পক্ষ, যেমন ওমানের মাধ্যমে আলোচনা চালাতে চায়।
ইরানের অবস্থান
ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। ইরান জানিয়েছে, তারা যুদ্ধ চায় না এবং পারমাণবিক অস্ত্রও তৈরি করতে চায় না। তবে তাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা প্রয়োজন। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি আমাদের সাথে সৎ মনোভাব নিয়ে আলোচনা করতে চায়, তবে আমরা সেই পথে যাব। কিন্তু যদি তারা আমাদের ওপর চাপ তৈরি করতে চায়, তাহলে কোনো সমঝোতা হবে না।’
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানও এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘কূটনীতি মানে আত্মসমর্পণ নয় এবং বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা চাপের মাধ্যমে সম্ভব নয়।’ এর মানে হলো, ইরান কোনোভাবেই হুমকির কাছে নত হতে রাজি নয়, বরং তারা নিজ স্বার্থ রক্ষা এবং বৈশ্বিক শান্তির জন্য সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। তেহরান জানিয়েছে, তারা কেবল সম্মান ও নিরাপত্তা চায়, যুদ্ধ নয়।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোরও একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। যে কোনো একতরফা পদক্ষেপ পুরো অঞ্চলে যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান সরাসরি আলোচনায় বসতে সক্ষম হয়, তবে তা বৈশ্বিক শান্তির জন্যই কল্যাণকর।
মন্তব্য করুন