১৫ বছর আগে এক সহপাঠীর আমন্ত্রণ বদর খান সুরির জীবন পুরোপুরি বদলে দিয়েছিল। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের মুখোমুখি, কারণ তার বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনে স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের এক সদস্যের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ভারতের দিল্লি শহরের জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বদর খান সুরি ও তার সহপাঠীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বসে আলোচনা করছিলেন। সেখানে তার সহপাঠী এক আন্তর্জাতিক ত্রাণ কাফেলার কথা জানায়, যা গাজায় পাঠানো হবে।
গাজা, ফিলিস্তিনের একটি ভূখণ্ড, যেটি হামাস নামে এক সশস্ত্র ইসলামি সংগঠন দ্বারা পরিচালিত হয় এবং ইসরায়েল এর উপর কঠোর অবরোধ আরোপ করেছে।
যুদ্ধ ও সংঘাত বিষয়ক অধ্যয়নরত সুরি, যিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতি নিয়ে আগ্রহী ছিলেন, এই ত্রাণ কাফেলায় অংশগ্রহণের প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন। এটি তার কাছে একটি বিরল সুযোগ ছিল, যেখানে তিনি বিশ্বের অন্যতম বিতর্কিত সংঘাত- ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাত-অনুভব করতে পারবেন। তার সহপাঠী বিবিসিকে জানান, সেদিন সুরি সানন্দে এই সফরে যাওয়ার জন্য সম্মতি দিয়েছিলেন।
সেই কাফেলা দিল্লি থেকে যাত্রা শুরু করে এবং নানা দেশে ভ্রমণ করে গাজার উদ্দেশ্যে পৌঁছায়। সুরি গাজায় পৌঁছানোর পর সেখানকার বাস্তবতা দেখে গভীরভাবে প্রভাবিত হন। গাজার বিধবা, প্রবীণ এবং অসহায় মানুষদের সহায়তা করার কাজে মনোনিবেশ করেন।
সেখানেই তার পরিচয় হয় মাফেজ সালেহ নামে এক ফিলিস্তিনি নারীর সঙ্গে, যিনি সাবেক হামাস উপদেষ্টার কন্যা ছিলেন। মাফেজ তখন গাজায় একটি মানবিক সংস্থায় কাজ করছিলেন এবং তার সঙ্গে পরিচয়ের পর কিছুদিনের মধ্যেই সুরি ও মাফেজ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
বিয়ে হওয়ার পর সুরি ও মাফেজ দিল্লিতে বসবাস করতে শুরু করেন। সেখানে সুরি তার গবেষণার কাজ চালিয়ে যান এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। এক দশক পর, তারা যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান, যেখানে সুরি জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টডক্টোরাল ফেলো হিসেবে যোগ দেন। তাদের জীবন বেশ শান্তিপূর্ণভাবে চলছিল এবং সুরি গবেষণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করছিলেন। তবে, চলতি মাসের ১৭ মার্চ একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে।
ভার্জিনিয়ায় সুরির বাড়ির দরজায় পুলিশ টোকা দেয় এবং তাকে গ্রেপ্তার করে। মার্কিন কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, সুরির বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের এক সদস্যের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে।
মার্কিন প্রশাসন হামাসকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং সুরির বিরুদ্ধে আনা এই অভিযোগকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসনবিরোধী কঠোর নীতির অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সুরি তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, আমি কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নই এবং হামাসের প্রতি আমার কোনো সমর্থন নেই।
তার গ্রেপ্তার বিশেষত মার্কিন প্রশাসনের তরফ থেকে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে নেওয়া কঠোর পদক্ষেপের অংশ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনপন্থি আন্দোলনকে ইহুদি বিরোধিতা এবং হামাসের প্রতি সমর্থন হিসেবে চিহ্নিত করছে।
সুরির ঘনিষ্ঠরা তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে অত্যন্ত দুর্বল বলে মনে করছেন। তার শিক্ষকরা জানান, সুরি একজন শান্তশিষ্ট এবং পরিশ্রমী ছাত্র ছিলেন এবং তিনি কখনোই উগ্রপন্থি মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। তার এক শিক্ষক বলেন, সে খুবই নম্র এবং পরিশ্রমী ছাত্র ছিল। তার বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ অত্যন্ত অবাস্তব।
একজন অধ্যাপকও মন্তব্য করেন, গাজার যুদ্ধ নিয়ে মতামত রাখা কোনো অপরাধ নয়। তিনি (সুরি) যুদ্ধ নিয়ে অধ্যয়নের একজন গবেষক। এটা তার পেশাগত দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তার মতে, সুরি কোনোভাবেই সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন না, কারণ তার গবেষণার বিষয় ছিল শান্তি ও সংঘাত।
সুরির বাবা তার ছেলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, আমার ছেলে হামাসের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয়। তার একমাত্র অপরাধ হলো, সে একজন ফিলিস্তিনি নারীকে বিয়ে করেছে। তিনি আরও বলেন, এগুলো শুধু অভিযোগ। এর পেছনে কোনো প্রমাণ নেই।
তার পরিবার আশাবাদী যে, সুরির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভ্রান্ত প্রমাণিত হবে এবং তাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হবে না। সুরির বাবা বলেন, আমরা বিশ্বাস করি যে, সুরির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা একেবারেই ভিত্তিহীন।
সুরির গ্রেপ্তার আন্তর্জাতিক স্তরে একটি বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতি, ফিলিস্তিনপন্থি আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর গুরুত্বপূর্ন আলোচনা উত্থাপন করেছে। বিশেষত, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি এবং ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাতের প্রেক্ষাপটে এ ঘটনা আরও একবার সমালোচনার সৃষ্টি করেছে।
এটি একটি স্মরণীয় ঘটনা, যা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মানবাধিকার দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন একটি আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
মন্তব্য করুন