পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ইরানকে নিয়ে বিতর্ক ছাড়ছে না। ইরানের অবিচল দাবি, তাদের যে পারমাণবিক কর্মসূচি তা পুরোটাই শান্তিপূর্ণ। তবে ইরান কখনোই তার আসল উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেনি। এটি নিয়ে নানা রকমের বিতর্ক চলছে। ইরান নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সন্দেহ আর অভিযোগের শেষ নেই। ইরানকে ঘিরে এসব বিতর্কের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব সম্প্রদায় নানা ধরনের কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিছু দেশ যেমন চীন ও রাশিয়া, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সমর্থন করে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এর ঘোরবিরোধী। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, এর আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব এবং এর সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে সাজানো হয়েছে এ প্রতিবেদন।
শান্তিপূর্ণ না বিপজ্জনক?
ইরান দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তির উদ্দেশ্যে। তাদের মতে, পারমাণবিক শক্তি শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহার হবে। বর্তমানে ইউরেনিয়াম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করছে দেশটি। পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য ইউরেনিয়াম গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই বর্তমানে ইরানের হাতে থাকা ইউরেনিয়াম দিয়ে সহজেই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারবে। ইরান বারবার জানিয়েছে, তাদের সামরিক কার্যকলাপের কোনো উদ্দেশ্য নেই। তারা কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায় না।
বিশ্বের অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল, ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। তাদের সন্দেহ, ইরান হয়তো পারমাণবিক কর্মসূচি আড়াল করে আসলে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে চাইছে। অথচ ১৯৬০-এর দশক থেকেই ইসরায়েলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। সেই ইসরায়েলও ইরানের পারমাণবিক প্রোগ্রামের বিরোধিতা করে আসছে। ইসরায়েলের আশঙ্কা, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক হবে।
কোন পদক্ষেপে সমাধান
বিশ্বের অন্যতম দুই পরাশক্তি চীন ও রাশিয়া, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সমর্থন করে। তারা মনে করে, ইরানকে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। তাদের মতে, পারমাণবিক সমস্যার সমাধান কেবল কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে হতে পারে। এটা না হলে ইরানের ওপর একতরফা নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলবে। এভাবে কোনো সমাধান আসবে না। চীন ও রাশিয়া একযোগে যুক্তরাষ্ট্রের এই চাপ প্রয়োগের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে।
২০১৮ সালে একপাক্ষিকভাবে জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) চুক্তি থেকে বের হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর থেকে, ইরানের ওপর ‘সর্বোচ্চ চাপ’ প্রয়োগ করছে দেশটি। তারা ইরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখতে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও জটিল করেছে। ট্রাম্পের যুক্তি ছিল, ইরান চুক্তির শর্তাবলি পুরোপুরি মানছে না, যদিও কিছু প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইরান তখন পর্যন্ত চুক্তি মেনে চলছিল।
ইসরায়েল কী চায়
বিশ্বে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে উত্তেজনা বাড়ছে। ইসরায়েল বরাবরই আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছে, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে, তাহলে এটি ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। শুধু তাই নয়, ইরানকে নিয়ে ইসরায়েল পুরো মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিয়ে চিন্তিত। তাই ইসরায়েল ইরানকে সামরিকভাবে আক্রমণ করতে চায়। অনেকবার ইরানকে আক্রমণের জন্য প্রস্তুতির কথাও শোনা গেছে। আর এ কাজে তাদের বড় সঙ্গী হিসেবে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন ধরে ইরানে হামলার পরিকল্পনা করেছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক সমাজের বিরোধিতার কারণে তারা সরাসরি আক্রমণে যেতে পারেনি।
মিডল করিডর : ইরানের চ্যালেঞ্জ
বিশ্ব বাণিজ্য গত কয়েক বছরে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ করে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শিপিং রুটগুলোকে বিপজ্জনক করে তুলেছে। ফলে নতুন একটি বাণিজ্য পথ হিসেবে ‘মিডল করিডর’ উঠে এসেছে। এই রুট রাশিয়াকে বাইপাস করে মধ্য এশিয়া, আজারবাইজান, জর্জিয়া ও তুরস্কের মাধ্যমে ইউরোপে গেছে। ইসরায়েলের মিত্র আজারবাইজান এই রুটের কেন্দ্রে রয়েছে। রুটটি মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোকে কৌশলগতভাবে লাভবান করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের ওপর যেহেতু আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, এখন এই রুটের মাধ্যমে অন্যান্য দেশ বাণিজ্যিক শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। রুটটি ইরানকে পাশ কেটে যাওয়ার ফলে ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব কমে যেতে পারে।
সুবিধা নিচ্ছে কারা
আজারবাইজান, ইসরায়েল ও তুরস্ক এই নতুন বাণিজ্য পথকে কৌশলগত সুবিধা হিসেবে দেখছে। ককেসাস অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ আজারবাইজান। বর্তমানে এ রুটের মাধ্যমে দেশটি ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ পথ হয়ে উঠছে। শুধু তাই নয়, আজারবাইজানে অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী ইসরায়েল। এর মাধ্যমে ইসরায়েল আঞ্চলিক প্রভাব আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। আবার মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে তুরস্ক। এ করিডোরের মাধ্যমে তুরস্ক ইরানের প্রভাব কমিয়ে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য স্থাপন করতে চায়।
পাল্টাপাল্টি হুঁশিয়ারি
এদিকে ইরানকে দুই মাসের আলটিমেটাম দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পরমাণু ইস্যুতে সমঝোতায় আসার জন্য দেশটিকে তিনি এ আলটিমেটাম দিয়ে একটি চিঠিও পাঠিয়েছেন। ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। প্রয়োজনে দেশটির শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের হুমকিও দিয়েছেন তিনি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কূটনৈতিক সমাধানকে অগ্রাধিকার দেন। তবে ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র সক্ষমতা অর্জনের পথে এগিয়ে যায়, তাহলে তিনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন। আমাদের সে সামর্থ্য রয়েছে এবং আমরা আরও এগিয়ে গিয়ে ইরানের শাসনব্যবস্থাকেও হুমকি দিতে পারি।
অন্যদিকে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইরানে হামলা হলে কঠোর পরিণতির হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যদের জানা উচিত, তারা যদি ইরানি জাতির ক্ষতি করে এমন কিছু করে, তাহলে তাদের কঠোর চপোটাঘাত করা হবে।
শান্তি না যুদ্ধ?
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, তার পারমাণবিক অস্ত্রের সম্ভাবনা এবং আঞ্চলিক ভূরাজনীতি বিশ্বকে দুটি প্রধান প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে- এক, ইরান কি পারমাণবিক বোমা তৈরি করবে? দুই, শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব না কি সামরিক পদক্ষেপ প্রয়োজন? এখন ইরান এবং এর আন্তর্জাতিক প্রতিপক্ষদের সামনে দুটি পথ উন্মুক্ত- একটি কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান, অথবা শক্তির মাধ্যমে পরিস্থিতির সমাধান। বিশ্ব এখন এমন অবস্থানে দাঁড়িয়েছে, যেখানে পরবর্তী পদক্ষেপ ইরান, ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে।
বর্তমান পরিস্থিতি যে কোনো সময় শান্তিপূর্ণ সমাধান অথবা যুদ্ধের দিকে মোড় নিতে পারে। ফলে পুরো মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্ব নিরাপত্তা এখন একটি বড় ঝুঁকিতে রয়েছে।
তথ্যসূত্র : সৌদি গ্যাজেট, জিউইশ নিউজ সিন্ডিকেট, সিএনএন, আলজাজিরা
মন্তব্য করুন