মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় গাজায় অস্ত্রবিরতি চুক্তি বড় সফলতা হিসেবে দেখা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক এক মাসের মধ্যে সেটি ভেঙে পড়ল। ইসরায়েল নতুন করে হামলা চালাচ্ছে। এই চুক্তির ব্যর্থতা ইসরায়েলের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও ট্রাম্পের প্রভাবকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ট্রাম্পের বিশ্বাস ছিল, তিনি ইসরায়েলকে গাজা সমস্যায় একটি কার্যকর সমাধান দিতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি বা তার প্রশাসন গাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বিশ্বের অনেক দেশ ও ধর্মীয় সম্প্রদায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। তাদের বিশ্ব মানবতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। কীভাবে গাজার অস্ত্রবিরতির চুক্তি ভেস্তে গেল, ইসরায়েলের হামলার মূল লক্ষ্য কী এবং ট্রাম্পের ভূমিকা কীভাবে সংঘাতকে ভয়াবহ করছে- এসব নিয়েই সাজানো হয়েছে এ প্রতিবেদন।
ভেস্তে যাওয়া অস্ত্রবিরতি
ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ রক্ষণশীল উপস্থাপক তাকার কার্লসন সম্প্রতি কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুলরহমান আল-থানির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ট্রাম্প নভেম্বরে নির্বাচিত হলেন, জানুয়ারিতে ক্ষমতায় বসলেন, আর সঙ্গে সঙ্গেই অস্ত্রবিরতি হলো।’ কাতারের প্রধানমন্ত্রীও স্বীকার করেন, ‘আমরা ১৫ জানুয়ারিতে যে চুক্তিতে পৌঁছেছি, তা প্রায় ৯৫ শতাংশ একই ছিল যা গত ডিসেম্বর ও মার্চে আলোচনা হয়েছিল। বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করা সত্ত্বেও ট্রাম্পের ক্ষমতা নেওয়ার আগেই চুক্তিটি করার জন্য কাতার তৎপর ছিল। কারণ ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলে আশঙ্কা ছিল। কিন্তু ১৮ মার্চ ইসরায়েল দেখিয়ে দিল, এ চুক্তি মানার জন্য তাদের ওপর কোনো চাপ নেই। তারা গাজার ওপর ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়ে ৪০০-র বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।’
ট্রাম্পের দুর্বল অবস্থান
ট্রাম্প প্রশাসনও ইসরায়েলকে গাজায় হামলা চালানোর অনুমোদন দিয়েছে। জাতিসংঘে মার্কিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘গাজায় যুদ্ধ পুনরায় শুরু হওয়ার জন্য একমাত্র হামাসই দায়ী।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ঘটনার ফলে স্পষ্ট যে ট্রাম্প প্রশাসন গাজা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি নতুন ‘শেরিফ’ হয়ে এসেছেন। কিন্তু নেতানিয়াহু তার কথা পাত্তাই দিচ্ছে না। ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের ইসরায়েল-বিশেষজ্ঞ মারওয়া মাজিয়াদ বলেন, এখন কেউ ট্রাম্পের কথাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে বিতর্ক
অস্ত্রবিরতি হলেও ট্রাম্প পরে গাজার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া এবং ফিলিস্তিনিদের জর্ডান ও মিসরে পাঠানোর পরিকল্পনা করেন। এ প্রস্তাবে আরব দেশগুলো উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ দ্বিতীয় ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে গিয়ে ট্রাম্পকে বোঝান, এ পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্যে চরমপন্থা উসকে দিতে পারে। এরপর আরব দেশগুলো গাজার পুনর্গঠনের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করে। মিসর এই পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দেয় এবং ৫৩ বিলিয়ন ডলারের একটি পুনর্গঠন পরিকল্পনা প্রকাশ করে। এতে গাজায় নতুন বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর তৈরির প্রস্তাব রাখা হয়, তবে হামাসকে কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। ইসরায়েল সরাসরি এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে, আর ট্রাম্প প্রশাসন দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থান নেয়।
পুনরায় যুদ্ধ
মার্চের শুরুতে অর্থাৎ এই রমজানে ইসরায়েল গাজায় খাদ্য সরবরাহ কমিয়ে দেয় এবং বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। এর কিছুদিনের মধ্যেই তারা নতুন করে হামলা শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করেছিল, যাতে হামাস অবশিষ্ট ২৭ জন ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেয় এবং অস্ত্রবিরতির সময়সীমা বাড়ানো যায়। কিন্তু হামাস চেয়েছিল, অস্ত্রবিরতির দ্বিতীয় ধাপে যাওয়া হোক। ইসরায়েল ও ট্রাম্প প্রশাসন গাজার যুদ্ধে কী লক্ষ্য পূরণ করতে চায়? তারা মূলত হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই এবং গাজা থেকে তাদের প্রভাব কমিয়ে আনতে চায়। কিন্তু গাজার মানুষ, বিশেষত হামাস, ইসরায়েলের এ পরিকল্পনা মেনে নেবে না। ইসরায়েল প্রথমে ভাবছিল, গাজার জনগণ যদি শাস্তির মুখে পড়ে, তবে তারা হামাসের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে দাঁড়াবে, কিন্তু সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। এরপর তারা গাজার মানুষকে গৃহহীন করে দেয়, তাদের খাবার, পানির সংকট সৃষ্টি করে, তবে তাতেও তারা কিছু লাভ করেনি।
আরব দেশগুলোর নিষ্ক্রিয়তা
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজার জন্য আরব লীগের পরিকল্পনা নেতৃত্বহীন হয়ে পড়েছে এবং ট্রাম্প প্রশাসনও ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ইসরায়েল নতুন করে যুদ্ধ শুরু করেছে। এদিকে, ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থি মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির সরকারে ফিরে আসার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি জানুয়ারিতে অস্ত্রবিরতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন। বিশ্লেষক মারওয়া মাজিয়াদ মনে করেন, ইসরায়েলের এ হামলার জন্য দায়ী মূলত আরব দেশগুলোর ব্যর্থতা। মিসর, কাতার ও সৌদি আরব ট্রাম্পকে বোঝাতে পারেনি যে, নেতানিয়াহু তার লক্ষ্যের পথে বাধা তৈরি করছে। তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প নেতানিয়াহুর ওপর চাপ বজায় রাখতে পারতেন। কিন্তু আরব দেশগুলো কেন তা করতে পারল না? এটা রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। আরব দেশগুলো কি আদৌ চায় যে নেতানিয়াহু ক্ষমতায় থাকুক?
নেতানিয়াহুকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ
বিশ্লেষকদের মতে, মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই গাজায় সামরিক অভিযান চালানো হচ্ছে। ইসরায়েলেরই সামরিক বিশ্লেষক আমোস হরেল স্পষ্টভাবে বলেছেন, এই যুদ্ধ পরিচালনার পেছনে তিনটি বড় কারণ রয়েছে। এক, নেতানিয়াহুর সরকার টিকিয়ে রাখা। দুই, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। তিন, ডানপন্থি মিত্রদের খুশি রেখে জনগণের মধ্যে অতিরিক্ত ক্ষোভের সঞ্চার না করা। নেতানিয়াহুর জন্য এ মাস শেষে বাজেট পাস করানো অত্যন্ত জরুরি। সেটি করতে ব্যর্থ হলে তার সরকার ভেঙে যাবে এবং ইসরায়েলকে নতুন নির্বাচনে যেতে হবে। এ বাজেট যদি অনুমোদিত হয়, তবে তার সরকার ২০২৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবে। তবে বাজেট পাসের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আলট্রা-অর্থডক্স দল ‘ইউনাইটেড তোরা জুডাইযম’ (ইউটিজে)। তারা হুমকি দিয়েছিল, যদি ইহুদি যুবকদের সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগ থেকে ছাড় দেওয়া না হয়, তবে তারা বাজেটের পক্ষে ভোট দেবে না। এ পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহু নতুন সমর্থনের সন্ধান করছিলেন। কয়েক সপ্তাহ ধরেই গুঞ্জন চলছিল, কট্টর ডানপন্থি নেতা ইতামার বেন-গভিরের ‘জিউইশ পাওয়ার’ দল সরকারে ফিরতে পারে। হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বেন-গভির ঘোষণা দেন, তার দল সরকারে ফিরে আসছে। কারণ নেতানিয়াহু যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ফলে বাজেট নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে গেছে, নেতানিয়াহুর সরকার এখন নিরাপদ।
এ ছাড়া নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রভাব স্পষ্ট। ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর নেতানিয়াহুর আচরণে পরিবর্তন এসেছে। তিনি ইসরায়েলের সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থায় তার অনুগত ব্যক্তিদের বসানো শুরু করেছেন। সেনাপ্রধান হেরজি হালেভিকে সরিয়ে সেখানে এয়াল জামিরকে বসানো হয়। জনপ্রিয় সামরিক মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারিকে বরখাস্ত করা হয়, আর গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর নেতৃত্ব দেওয়া ইতজিক কোহেনকে সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়।
শুধু সেনাবাহিনী নয়, নেতানিয়াহু ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘শিন বেত’-এর ওপরও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে চান। কারণ সংস্থাটি তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কাতার থেকে অবৈধ অর্থ নেওয়ার অভিযোগে তদন্ত করছে। শিন বেতের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে, তিনি তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের সহজেই দমন করতে পারবেন।
গাজা নিয়ন্ত্রণে নেতানিয়াহু বিমান হামলার কৌশল নিয়েছেন। কারণ স্থল অভিযানের চেয়ে বিমান হামলা রাজনৈতিকভাবে তার জন্য নিরাপদ। এতে সেনাদের মোতায়েন করতে হয় না এবং রাজনৈতিক বিরোধিতাও তুলনামূলকভাবে কম হয়। এরইমধ্যে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীতে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। যদিও হামলায় শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হচ্ছে, তবু এটি ইসরায়েলের ভেতরে ততটা আলোড়ন সৃষ্টি করছে না।
নেতানিয়াহু এ হামলার কোনো সুস্পষ্ট সামরিক লক্ষ্য নেই। হামাস জানুয়ারি থেকে কোনো হামলা চালায়নি, ফলে এটি প্রতিরোধমূলক হামলাও নয়। ইসরায়েল নিজেই বলছে, তারা মূলত হামাসের বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তাদের টার্গেট করছে। অর্থাৎ হামাসের সামরিক সক্ষমতায় বড় কোনো আঘাত লাগেনি। নেতানিয়াহুর একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে, হামাসকে চাপ দিয়ে বন্দি বিনিময়ের প্রথম ধাপ দীর্ঘায়িত করা, কিন্তু যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে না যাওয়া। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, ইসরায়েলের এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য সামরিক নয়, বরং পুরোপুরি রাজনৈতিক। গাজায় সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করাই এর মূল লক্ষ্য।
দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পথ বন্ধ
ট্রাম্প প্রশাসনও এ যুদ্ধের মধ্যে সম্পূর্ণ ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারাও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য ফিলিস্তিনিদের নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে। ইসরায়েল ও ট্রাম্প প্রশাসন একযোগে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং দুই রাষ্ট্রের সমাধানের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। তবে ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূমির স্বাধীনতা চায়, আর সেটি তাদের একমাত্র বিকল্প। যদিও হামাস ও গাজার জনগণের উপর যত বেশি আক্রমণই চালানো হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কখনোই থামবে না।
নেতানিয়াহু এবং তার সরকার দাবি করলেও এ যুদ্ধ কখনোই তাদের বন্দিদের মুক্তির জন্য ছিল না। একাধিক চুক্তি এবং যুদ্ধবিরতি শর্তের মধ্যে ইসরায়েল একতরফাভাবে গাজা যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করেছে। হামাসের পক্ষ থেকে বন্দিদের মুক্তির জন্য যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, সেটিও নেতানিয়াহু প্রত্যাখ্যান করেছেন। যদি তার সরকার আসলেই বন্দিদের মুক্তির বিষয়ে অগ্রাধিকার দিত, তবে আগেই সমঝোতা চুক্তি হতে পারত। কিন্তু এতে যুদ্ধ শেষ হয়ে যেত, যা নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক জোটের পতন ঘটাত। এ যুদ্ধ এখন এক রাজনৈতিক কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মন্তব্য করুন