বর্তমানে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। পারমাণবিক ও সামরিক শক্তির প্রসার ইরানকে চক্ষুশূল করেছে। ইরান ব্যাপক আকারে পারমাণবিক প্রকল্পের জন্য ইউরেনিয়াম বাড়াচ্ছে। আর যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র ইসরায়েল ইরানকে পারমাণবিক শক্তি অর্জন করতে সরাসরি বাধা দিচ্ছে। তবে ইরান তার শক্তি বৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখতে এক চুল ছাড় দিতেও রাজি নয়। এতে সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা যেমন দেখা দিচ্ছে, বিশ্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ঝুঁকিতে পড়ছে। ইরান ও ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা, সম্ভাব্য সামরিক সংঘাত ও পরিস্থিতির বিশ্লেষণ থাকছে এ প্রতিবেদনে।
ইরানের সামরিক অনুশীলন
ইরান সম্ভাব্য ইসরায়েলি হামলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ রিপোর্ট করেছে, ইরান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করছে। সম্প্রতি ইসরায়েলি হামলার পরে গোপন স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বাড়িয়েছে। গত কয়েক মাসে ইরান সবচেয়ে তীব্র সামরিক অনুশীলন চালিয়েছে। এতে বিভিন্ন আক্রমণাত্মক অস্ত্র ব্যবহার করেছে তারা, যা যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও অন্য দেশগুলোর জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে।
ইরান ‘গ্রেট প্রফেট ১৯’ নামে একটি বড় সামরিক অনুশীলন শুরু করেছে, যা ইরানের ‘ইকতেদার বা শক্তি’ অনুশীলনের অংশ হিসেবে পরিচিত।
এ ছাড়া ইরান ইসলামিক রেভ্যুলিউশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি) ও সেনাদের এয়ার ডিফেন্স অনুশীলনসহ পারমাণবিক প্রতিরক্ষা অনুশীলন চালিয়েছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) বলেছে, তারা সবসময় পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে এবং আধুনিক প্রতিরক্ষা ও আক্রমণ কৌশল জন্য প্রস্তুত থাকে।
রাশিয়া ও চীনকে নিয়ে নৌ মহড়া
ইরান, রাশিয়া ও চীনের যৌথ নৌ অনুশীলন চলতি ১১-১৫ মার্চ পর্যন্ত ইরানের চাবাহার বন্দরের কাছে ওমান উপসাগরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই অনুশীলনে অংশ নিচ্ছে ইরান, রাশিয়া ও চীনের নৌবাহিনী। পাশাপাশি আজারবাইজান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওমান, কাজাখস্তান, পাকিস্তান, কাতার, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকছে।
অনুশীলনের মূল উদ্দেশ্য হলো আঞ্চলিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি, বহু-পক্ষীয় সহযোগিতা সম্প্রসারণ ও সমুদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এতে সামুদ্রিক লক্ষ্যস্থানে আঘাত, ভিবিএসএস (অর্থাৎ ভিজিট, বোর্ড, সার্চ ও সিজার), ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ, যৌথ অনুসন্ধান ও উদ্ধারসহ নানা কার্যক্রম রয়েছে। চীন, ইরান ও রাশিয়ার এটি পঞ্চম যৌথ নৌ অনুশীলন। ২০১৯ সাল থেকে অনুশীলনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিশেষ করে এ অঞ্চলের শিপিং রুট রক্ষা করার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
চীন এই অনুশীলনে বাওটো নামক টাইপ ০৫২ডি গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার ও গাওইউহু নামক টাইপ ৯০৩এ রিপ্লেনিশমেন্ট শিপ পাঠাবে। এই জাহাজগুলো দীর্ঘমেয়াদি অপারেশন পরিচালনা করতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, জাহাজগুলো চীনের নৌবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে, অঞ্চলটির নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে, ২০২৩ সালে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে চীন।
ইরানের শক্তি সৌদি আরবও
গত দুই বছরে ইরান ও সৌদি আরবের সম্পর্ক এগিয়ে গেছে, যা চীনের মধ্যস্থতায় সম্ভব হয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি সৌদি আরব সফর করেন এবং সেখানে ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে ইসলামিক ও আরব দেশগুলোর সম্মেলনে অংশ নেন। এরপর ২০২৪ সালের নভেম্বরে ইরানি প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান এবং সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের মধ্যে ফোনে আলাপ-আলোচনা হয়। এ ছাড়া আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন স্তরে অব্যাহত আলোচনা হয়েছে। ইরান, সৌদি ও চীনের মধ্যে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে দুটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৩ সালে ইরান-সৌদি সম্পর্ক পুনর্মিলন মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই সফলতা শুধু দুই দেশের স্বার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং পুরো অঞ্চলের শান্তি এবং স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক অনুশীলন
অন্যদিকে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চলতি মার্চেই ভূমধ্যসাগরে একটি যৌথ সামরিক মহড়া করেছে। এই অনুশীলনে ইসরায়েলি ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীসহ এফ-৩৫আই, এফ১৫আই ও বি-৫২ স্ট্র্যাটেজিক বোমারু বিমান অংশ নিয়েছে। অনুশীলনের উদ্দেশ্য ছিল দুই দেশের বিমান বাহিনীর মধ্যে অপারেশনাল সমন্বয় অনুশীলন করা এবং আঞ্চলিক হুমকির মোকাবেলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
অনুশীলনটি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে আয়োজন করা হয়েছিল। এ ছাড়া, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে অনুশীলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইরানকে প্রতিরোধ করার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা সামরিক অনুশীলনগুলোকে এ অঞ্চলের সামরিক উত্তেজনা, শক্তি রক্ষা ও কৌশলগত স্বার্থের প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন।
ইরান ও ইসরায়েলের সামরিক পরিস্থিতি
ইরান পারমাণবিক স্থাপনাগুলো গভীর বাংকারে (মাটির নিচে) তৈরি করছে, যাতে সাধারণ বোমা দিয়ে ধ্বংস করা না যায়। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটোমিক এনার্জি এজেন্সির (আইএইএ) রিপোর্ট অনুসারে, ইরান যদি ৬০-৯০ শতাংশ ইউরেনিয়াম উৎপাদন শুরু করে, তাহলে এক মাসের মধ্যে তারা চার-পাঁচটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারবে।
অন্যদিকে ইসরায়েল ছোট আক্রমণ, যেমন ১৯৮১ সালে ইরাকে এবং ২০০৭ সালে সিরিয়ায় করেছিল- এমন আক্রমণ ইরানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। কারণ ইরানের বিস্তৃত পারমাণবিক প্রকল্পের জন্য অনেক বেশি বিমান ও আক্রমণ প্রয়োজন হবে। একবার হামলা করেই ইরানের পারমাণবিক শক্তি শেষ করা যাবে না। তবে ইসরায়েল বসে নেই, দেশটি আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরইমধ্যে ইসরায়েল ফাইটার জেটগুলোকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছে, যাতে তারা ইরানের গভীর স্থাপনাগুলো ধ্বংস করতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল এককভাবে ইরানকে আক্রমণ করে শেষ করতে পারবে না। এজন্য তাদের আমেরিকার সহায়তা প্রয়োজন হবে, কারণ আক্রমণের জন্য রিয়েল-টাইম ডিফেন্স সহায়তা প্রয়োজন। এ সহায়তা আমেরিকা তাদের করতে পারে। ইরান জানে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের পারমাণবিক প্রকল্প বন্ধ করতে চায়। এ জন্য বর্তমানে ইরান নতুন রাডার ও অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট মিসাইল ব্যবস্থা স্থাপন করছে, যা আক্রমণকে আরও কঠিন করবে।
ইরানের শুধু সামরিক শক্তি নয়, তার সাথে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি, ইরাকের মিলিশিয়া; আর চীন তো রয়েছেই। এসব গোষ্ঠী ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
এদিকে ইরান যদি হামলার শিকার হয়, পাল্টা হামলা তারা চালাবেই। আর তখন আমেরিকা ইসরায়েলের পাশে এসে দাঁড়াবে। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন পর্যন্ত ইরানকে সামরিকভাবে আক্রমণ করার পক্ষে নন, বরং কূটনৈতিক উপায় ও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চাপে রাখতে চাইছেন। তবে যদি এসব উপায় ব্যর্থ হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ব্যবস্থা নিতে পারে।
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা
গত ৮ মার্চ ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে বলেন, কিছু শক্তিশালী দেশ আলোচনা করতে চায়, তবে আলোচনা সমস্যার সমাধান করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং তাদের নিজেদের শর্ত চাপিয়ে দেওয়ার জন্য। তাদের আলোচনার লক্ষ্য কেবল পারমাণবিক বিষয় নয়, বরং তারা ইরানের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা ও আন্তর্জাতিক প্রভাবের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে চায়।
এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৮ সালে ‘ম্যাক্সিমাম প্রেসার’ পলিসি গ্রহণ করেছিলেন এবং ইরান থেকে পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করেছিলেন। ফলে ইরান তার পারমাণবিক কার্যক্রমের সীমা বাড়িয়েছে। ইরান নিজেদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে। যদিও পরে বাইডেন প্রশাসন ও ইউরোপীয় নেতারা চুক্তি পুনরায় চালু করার চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি।
এদিকে, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন পারমাণবিক আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী হতে প্রস্তুত রাশিয়া। জাতিসংঘের পারমাণবিক তদারকি সংস্থার (আইএইএ) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি সম্প্রতি বলেছেন, ইরানের কার্যক্রমের ওপর নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করার জন্য সময় কমে যাচ্ছে। ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পরবর্তীতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে এসব ইউরেনিয়াম কাজে লাগবে।
ইরান বরাবরই দাবি করে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির উদ্দেশ্য শান্তিপূর্ণ। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও গাজায় ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইরান সামরিক শক্তি আরও বাড়ানোর হুমকি দিয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলও ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে দিতে চায় না।
এ পরিস্থিতিতে মার্কিন সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কোনো সমঝোতা চুক্তি সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘ইরানের শাসকরা (আয়াতুল্লাহরা) ইসরায়েল ধ্বংস করতে চান। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করার জন্য ইসরায়েলকে প্রয়োজনীয় সামরিক সহায়তা দিতে হবে।’
তথ্যসূত্র: য্যুইশ নিউজ সিন্ডিকেট (জেএনএস), গ্লোবাল টাইমস, টাইমস অব ইসরায়েল, তেহরান টাইমস, আলজাজিরা
মন্তব্য করুন