মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদেশি সহায়তা বন্ধের ঘোষণা বিশ্বব্যাপী নানা প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।
২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৫৯.৯ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সহায়তা প্রদান করেছিল, যার বেশিরভাগ অংশই উন্নয়নমূলক ও মানবিক সহায়তার জন্য বরাদ্দ ছিল। তবে এ সহায়তা হ্রাস বা বাতিল করার ফলে কোন দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে পারে, তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
সবচেয়ে বেশি সহায়তা পেয়েছিল ইউক্রেন
যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) থেকে ইউক্রেন ২০২৩ সালে ১৪.৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা পেয়েছে, যা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ। ট্রাম্প প্রশাসন যদি এই সহায়তা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়, তাহলে রাশিয়ার সঙ্গে চলমান যুদ্ধের কারণে দেশটি ব্যাপক আর্থিক ও সামরিক সংকটে পড়তে পারে।
অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশ
উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশও বড় অঙ্কের মার্কিন সহায়তা পেয়ে থাকে। ২০২৩ সালে জর্ডান ৭৭০ মিলিয়ন ডলার, ইয়েমেন ৩৫৯.৯ মিলিয়ন ডলার এবং আফগানিস্তান ৩৩২ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পেয়েছে। এ দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও মানবিক পরিস্থিতি এমনিতেই নাজুক। সহায়তা বন্ধ হলে খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বাংলাদেশে মার্কিন সহায়তার প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা সংক্রান্ত ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রতি বছর গড়ে ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলারের কাছাকাছি সহায়তা পেয়ে আসছে। ইউএসএআইডির তথ্য মতে, এই অর্থ খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গণতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থা, পরিবেশ ও জ্বালানি খাতে ব্যয় হয়।
বিশেষ করে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের একটি বড় অংশ মার্কিন সহায়তার মাধ্যমে আসে। যদিও মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও পুষ্টি কার্যক্রমের অর্থায়ন বজায় রাখা হবে, তবে অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে বাজেট সংকোচন হলে বাংলাদেশও ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উদ্বেগ
যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি সহায়তা বন্ধের ফলে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেছেন, এই তহবিল সংকটের ফলে শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য পরিচালিত অনেক প্রকল্প ব্যাহত হতে পারে। ২০২৩ সালে মার্কিন সহায়তায় জাতিসংঘ ২.৪৯ বিলিয়ন ডলার পেয়েছিল, যা প্রায় ১০০টি দেশে ১২২ মিলিয়ন মানুষের জন্য জীবন রক্ষাকারী সহায়তা প্রদান করতে সাহায্য করেছিল।
ব্র্যাক ও অন্যান্য সংস্থার প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কমে যাওয়ার কারণে কয়েকটি প্রকল্প স্থগিত করেছে। ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ জানিয়েছেন, বাংলাদেশে মার্কিন অর্থায়নের ছয়টি প্রকল্প ইতোমধ্যে স্থগিত করা হয়েছে, যার মধ্যে তিনটি ব্র্যাক সরাসরি পরিচালনা করছিল এবং বাকিগুলো অন্য এনজিওগুলোর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছিল।
বিশ্বব্যাপী প্রভাব ও ভবিষ্যৎ
মার্কিন সহায়তা বন্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী পানীয় জল, স্যানিটেশন ও আশ্রয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ হতে পারে। ইউএসএইডের সাবেক পরিচালক ডেভ হার্ডেন একে ‘অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ’ সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেছেন, যা বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তা কর্মসূচিগুলো স্থগিত করে দিতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক কূটনীতির ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। সহায়তা হ্রাস বা বন্ধ হলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য নতুন তহবিল সংগ্রহ করা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা, চিকিৎসা, শিক্ষা ও মানবিক সহায়তা সংকটে পড়তে পারে, যা বিশ্বের দরিদ্র ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
সূত্র : আল-জাজিরা
মন্তব্য করুন