যুক্তরাজ্যের নির্বাচনী ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভরাডুবি হয়েছে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির। এর ফলে ১৪ বছর পর ক্ষমতা হারাল ঋষি সুনাকের দল। লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমারকে অভিনন্দন জানিয়ে পরাজয় মেনে নিয়েছেন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ঋষি। হারের দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি। প্রশ্ন হলো, এক যুগের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার পর কেন এমন ভরাডুবি কনজারভেটিভ পার্টির?
২০১০ সালে নির্বাচনে জয়ের পর কনজারভেটিভ ও দ্য সেন্ট্রিস্ট লিবারেল ডেমোক্র্যাটসরা মিলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে।
তখন প্রধানমন্ত্রী হন ডেভিড ক্যামেরন। বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের মধ্যে ক্ষমতায় আসেন ক্যামেরন। ক্ষমতায় এসেই তিনি যুক্তরাজ্যের বাজেট কমানোর সিদ্ধান্ত নেন। তার আমলে জিডিপি প্রায় ৪১ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশে নেমে আসে। ২০১৬ সালে ব্রেক্সিটের কারণে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয় ক্যামেরনকে।
এই কনজারভেটিভ নেতা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে যুক্তরাজ্যের যুক্ত থাকার পক্ষে ছিলেন। ক্যামেরনের পর যুক্তরাজ্যের গদিতে বসেন থেরেসা মে। যুক্তরাজ্য কীভাবে ইইউ ছেড়ে যাবে, সে বিষয়ে হওয়া চুক্তি চূড়ান্ত করতে প্রয়োজনীয় আইনের সংসদীয় অনুমোদন পেতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। পরে ২০১৯ সালে পদত্যাগ করেন মে। এরপর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হন বরিস জনসন। ব্রেক্সিট করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওই বছরের জাতীয় নির্বাচনে বিপুল জয় পায় জনসনের দল কনজারভেটিভ পার্টি। জনসনের তিন বছরের শাসনামল বিতর্ক এবং দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত ছিল। করোনাকালে বিধি ভেঙে জনসন আনন্দ-উৎসব করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন জনসন।
জনসনের পরে ৪৯ দিনের জন্য যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হন লিজ ট্রাস। এটি ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে কম প্রধানমন্ত্রীর স্থায়িত্বকাল। যুক্তরাজ্যে যখন জিনিসপত্রের দাম এবং জ্বালানির খরচ বাড়তে থাকে, তখন বিপর্যয়কর কর পরিকল্পনা আনেন লিজ ট্রাস। তার কর কমানোর পরিকল্পনায় বিশ্বব্যাপী বন্ড বাজারে কয়েক সপ্তাহ অস্থিরতা চলে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রকাশ্যে যুক্তরাজ্য সরকারকে তিরস্কার করে। এই সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করেন ট্রাস। এরপর কনজারভেটিভ পার্টি ভরসা করে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং যুক্তরাজ্যের সে সময়ের অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাকের ওপর। মাত্র ৪২ বছর বয়সে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হন সুনাক। আধুনিক ব্রিটেনের ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঋষির বয়স সবচেয়ে কম। ক্ষমতায় এসেই নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে যুক্তরাজ্যের অচলাবস্থা কাটানোর চেষ্টা করেন ঋষি সুনাক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণচেষ্টার পাশাপাশি পরিবর্তন আনেন অভিবাসন নীতিতে। কিন্তু ১৪ বছরের অনিয়মের প্রভাব কাটিয়ে জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হন। একপর্যায়ে গত ২২ মে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেন সুনাক। ৪ জুলাই নির্বাচনের আগেই বিভিন্ন জরিপে কনজারভেটিভ পার্টির ভরাডুবির আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। চূড়ান্ত ফলে যা সত্য প্রমাণিত হয়।
কনজারভেটিভ সরকারের ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা নিয়ে গবেষণাপত্র ‘দ্য কনজারভেটিভ ইফেক্ট’-এর সহ-লেখক টম এগারটন এনবিসি নিউজকে বলেন, ‘গত চার বছর এই পার্টি বিশেষ করে লিজ ট্রাসের মতো লোকেরা যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। লিজ ট্রাসের আগে দুর্নীতি ও অনিয়ম এমনভাবে জেঁকে বসে যে, এ থেকে যেন বাঁচার কোনো উপায় নেই। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছিল। করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এ পরিস্থিতিকে আরও অন্ধকারে নিয়ে যায়। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে আরও কয়েকজন বিশ্লেষক বলেন, করোনা মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে লাগামছাড়া মূল্যস্ফীতি এবং ব্রেক্সিট যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আর এটাই ডুবিয়েছে কনজারভেটিভ পার্টিকে। স্বাধীন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ব্রিটেনেস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চ (এনআইইএসআর) জানায়, ইইউর সঙ্গে থাকলে এখন ইউকের জিডিপি ২ থেকে ৩ শতাংশ বেশি থাকত। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের কর্মক্ষমতা নিয়ে ভোটাররা অসন্তুষ্ট ছিল। দ্য আটলান্টিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন চিকিৎসাসেবার জন্য অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছেন। ২০২১ সালের জুলাইয়ের পর দেশটিতে খাদ্যের দামও ২০ শতাংশ বেড়েছে। ক্ষমতায় আসার পর অভিবাসন ইস্যুতেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন ঋষি। তিনি অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করার জন্য অবৈধ অভিবাসনের ইস্যুতে সোচ্চার হন। অভিবাসীদের রুয়ান্ডায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচিত হন তিনি। জনগণের চোখে সুনাকের ধুলা দেওয়ার এ চেষ্টাও তার দলের বিপর্যয়ের একটি কারণ।
তথ্যসূত্র: আলজাজিরা, রয়টার্স, বিবিসি
মন্তব্য করুন