‘হানিট্র্যাপ’ বা ‘মধুফাঁদ’ শব্দটি আজ আর কল্পনার জগতে নেই। পশ্চিমা গোয়েন্দা কৌশলের এ এক পুরোনো পদ্ধতি, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও পরিশীলিত ও ভয়ানক হয়ে উঠেছে। প্রথম ব্যবহার হয় ১৯৭৪ সালে জন লে ক্যারের বিখ্যাত এক উপন্যাসে। এরপর গোটা দুনিয়ায় গুপ্তচরবৃত্তির একটি মারাত্মক অস্ত্র হয়ে ওঠে এই ‘হানিট্র্যাপ’।
মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) পাকিস্তান এই কৌশলকে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে- এ তথ্য জানা যায় ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতীয় সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের টার্গেট করে যৌনতার ফাঁদে ফেলার জন্য পাকিস্তান তৈরি করেছে একটি বিশেষ ইউনিট। যার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দপ্তরে গঠিত তথাকথিত ‘হানিট্র্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়’-এ। এখানেই স্থানীয় কলেজ থেকে বাছাই করে আনা হয় প্রায় ৯০০ সুন্দরী তরুণীকে, যাদের শেখানো হয় হিন্দি, পাঞ্জাবি, রাজস্থানি ভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও আচরণ- সবই ভারতীয় নারীদের মতো করে সাজিয়ে তোলা হয়।
পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর এ কৌশলের শিকার হয়েছেন বহু ভারতীয় কর্মকর্তা। ২০০৭ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত একাধিক ‘হানিট্র্যাপ’ ঘটনার অভিযোগ উঠেছে, যার মধ্যে রয়েছে ‘র’-এর অফিসার মনমোহন শর্মা, কেকে রঞ্জিত, বরুণ গান্ধীর মতো নাম।
২০২২ সালের নভেম্বরে কেন্দ্রীয় বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযোগ- যৌনতার ফাঁদে পড়ে তিনি পাকিস্তানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার করেছেন।
২০২৩ সালে ডিআরডিওর বিজ্ঞানী প্রদীপ কুরুলকরকেও গ্রেপ্তার করা হয়। পাকিস্তানি এক নারী, যিনি নিজেকে লন্ডনের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ‘জ়ারা দাশগুপ্ত’ পরিচয়ে হাজির করেছিলেন, তার সঙ্গে অনলাইন যোগাযোগ ছিল প্রদীপের। তদন্তে উঠে আসে, জ়ারা তাকে অশালীন ছবি পাঠাতেন এবং ভিডিও কলে কথা বলতেন। এর বিনিময়ে প্রদীপ গোপন সামরিক তথ্য ফাঁস করেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাক সেনার গোয়েন্দা ইউনিট হায়দরাবাদ (সিন্ধ) থেকেও একটি ‘হানিট্র্যাপ’ মডিউল পরিচালনা করে। প্রশিক্ষণের সময় মেয়েদের ভারতীয় নাম যেমন- পূজা, মুসকান, হরলিন ইত্যাদি দেওয়া হয়। তাদের চালচলন, ভাষা এমনভাবে গড়ে তোলা হয় যাতে ভারতীয় বলে ভুল হয়। প্রয়োজনে হিন্দু দেব-দেবীর ছবি দেওয়া হয় ঘরে, যেন ভিডিও কলের সময় সন্দেহ না হয়।
এই তরুণীদের পাশাপাশি যৌনকর্মী ও গরিব মহিলাদেরও কাজে লাগানো হয়। তাদের প্রশিক্ষণ দেন পাক সেনার ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। ভারতে আসার সময় তাদের জন্য হোটেল বুক করা হয়, সাজানো হয় ঘর- যেন পুরো পরিবার নিয়ে থাকছেন এমন ভান করা যায়।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে প্রকাশ্যে আসে ‘অপারেশন হায়দরাবাদ’-এর কথা। বলা হয়, এতে অন্তত ২০০ ভারতীয় সেনাকে ‘হানিট্র্যাপ’-এর জালে ফেলা হয়। এই মিশনের জন্য পাকিস্তান নাকি বছরে ৩৫০০ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ করে। তাও আবার এমন সময়, যখন পাকিস্তানের অর্থনীতি ভয়াবহ সংকটে।
এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত শুরু হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্ধুত্ব দিয়ে। ধীরে ধীরে কথাবার্তা ঘনিষ্ঠ হয়, তারপর যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ ছবি বা ভিডিও পাঠানো হয়। পরের ধাপে শুরু হয় ব্ল্যাকমেইল। সেনা বা পুলিশ কর্মকর্তার তখন তথ্য ফাঁস না করে উপায় থাকে না। অনেক সময় টাকাও হাতিয়ে নেওয়া হয়।
তবে এই কৌশল সবসময় সফল হয় না। বেশিরভাগ ভারতীয় কর্তাই সতর্ক থাকেন এবং পাক গুপ্তচর সংস্থার চাল ব্যর্থ করে দেন। কিন্তু একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার ফাঁদে পড়ার নজির গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে চিন্তায় ফেলেছে।
মন্তব্য করুন