মেহরাং বেলুচ যখন প্রথমবারের মতো একটি মর্গে প্রবেশ করেছিলেন, তখন তার বয়স মাত্র ১৫। অন্ধকারাচ্ছন্ন, দুর্গন্ধযুক্ত সেই কক্ষে প্রবেশ করে তিনি অনুভব করেছিলেন এক অভূতপূর্ব ভয়াবহতা। চারদিকে ছিল অজস্র মৃতদেহ, আর তাদের মধ্যে কোনো পরিচিত মুখ, পরিচিত চেহারা খুঁজে পাওয়ার জন্য, চোখের পানিতে ঝাপসা হয়ে উঠেছিল তার দৃশ্যমান পৃথিবী।
একে একে মৃতদেহগুলো দেখার পর তিনি যার দিকে তাকান, সেটি ছিল এমন এক ব্যক্তির, যিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে মনে হচ্ছিল। তার চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল, দাঁত খুলে নেওয়া হয়েছিল, বুকে পোড়ার দাগ ছিল। মেহরাং তখনও হতভম্ব।
তবে সেখানেই ছিল একটুকু স্বস্তি—কারণ সেটি তার ভাইয়ের মৃতদেহ ছিল না। তার ভাই, একজন পুলিশ কর্মকর্তা, ২০১৮ সালে বেলুচিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রায় এক বছর ধরে নিখোঁজ ছিলেন।
মর্গে সেই ভয়াবহ পরিবেশের মধ্যে অন্যরা তাদের প্রিয়জনের মৃতদেহ খুঁজছিলেন, একে একে সব মৃতদেহগুলো দেখে দেখে তারা শিউরে উঠছিলেন। তবে তাদের মধ্যে ছিল আশার আলোকবিন্দু—সম্ভবত এবারই তারা খুঁজে পাবেন তাদের প্রিয়জনকে।
মেহরাং জানালেন, যে ভয়াবহ কাজের মধ্যে তিনি প্রবেশ করেছিলেন, তা একসময় তার কাছে কিছুটা সহজ হয়ে গিয়েছিল। তিনি এক মর্গ থেকে আরেক মর্গে চলে যেতেন, জীবাণুনাশকের তীব্র গন্ধ, পোড়া গন্ধ আর পচা দেহের দুর্গন্ধের মধ্যে চলে যেতেন।
রোববার (২৩ মার্চ) ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী গত দুই দশকে হাজার হাজার বেলুচ নাগরিককে গুম করেছে।
এ বিষয়ে পাকিস্তান সরকার জানায়, নিখোঁজ ব্যক্তিরা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছেন বা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন। কিন্তু অধিকাংশ পরিবারের অভিযোগ, তাদের স্বজনদের আটক করা হয়েছে কোনো আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়াই, অথবা নিখোঁজ ব্যক্তিরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশের কারণে শিকার হয়েছেন।
গত দুই দশকে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী হাজার হাজার বেলুচ নাগরিককে গুম করেছে, অনেককেই অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অনেক বেলুচ নাগরিক কখনো ফিরে আসেননি। আর যারা ফিরে আসেন, তারা ছিলেন শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। তবে, যাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়, তাদের অধিকাংশই বেলুচিস্তানের অজ্ঞাত গণকবরগুলোতে পাওয়া যায়। সেইসব গণকবরের মৃতদেহগুলো এতটাই বিকৃত হয়ে যায়, শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
এমনকি বেলুচিস্তানের নির্ধারিত এলাকার মধ্যে, যেখানে অনেক পরিবার প্রিয়জনদের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাদের অনেকেই জানেন না, তাদের প্রিয়জনরা জীবিত আছেন কি না। তারা একেবারে কেবল নিখোঁজ হয়েছেন বা রাষ্ট্রের কোনো মর্মান্তিক শাস্তির শিকার হয়েছেন।
বেলুচিস্তানে, একদিকে গুম হওয়ার শিকার পুরুষরা, অন্যদিকে তাদের পরিবারের নারীরা—এই নারীদের জীবনের গল্পগুলো বহু বছর ধরে একই রকম আছড়ে পড়েছে। তারা এক যুগ ধরে তাদের প্রিয়জনদের খোঁজে অপেক্ষা করছেন এবং তাদের অপেক্ষার সময় কখনো কমে না, বরং আরও দীর্ঘতর হয়।
তারা সর্বদা তাদের প্রিয়জনের ফিরে আসার আশায় থাকে অথচ যে জীবনের শূন্যতা তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে, তা যেন এক অচেনা যন্ত্রণার সময় হয়ে দাঁড়ায়।
সাইরা বেলুচ এমনই এক অপেক্ষমাণ নারী, যার ভাই মুহাম্মদ আসিফ বেলুচ ২০১৮ সালের আগস্টে নুশকি শহর থেকে আটক হন। তার পরিবারের প্রথম দেখে টেলিভিশনে, যেখানে ভাইয়ের ছবি সম্প্রচারিত হয়। সেখানে মুহাম্মদ ভীত ও বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিলেন। কিন্তু তার পরিবারের দাবি, মুহাম্মদ কেবল তার বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিকে গিয়েছিলেন।
তবে পাকিস্তান সরকারের দাবি, মুহাম্মদ এবং অন্য আটকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগ ছিল এবং তারা আফগানিস্তানে পালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সাইরা তার ভাইকে অপরাধী নয়, বরং এক নিরপরাধ যুবক হিসেবে মনে করেন এবং তার প্রতি সরকারের আচরণে বিশ্বাসের অভাব অনুভব করেন।
সাইরা বলেন, মুহাম্মদ ছিল আমার সেরা বন্ধু। তিনি সব সময় হাসিখুশি থাকতেন, আমাদের জন্য উজ্জ্বল রোদ হয়ে। সেই সময় তার মায়ের উদ্বেগ ছিল যে, তিনি হয়তো একদিন তার ছেলের হাসির স্মৃতি ভুলে যাবেন।
যখন মুহাম্মদ নিখোঁজ হন, সাইরা তখন তার স্কুলের পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবং উত্তীর্ণ হয়েছিল। তিনি তার ভাইকে এই খুশির সংবাদ জানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেই আনন্দময় দিনটি হয়ে উঠেছিল এক গভীর শোকের দিন।
উল্লেখ্য, বেলুচিস্তান পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রদেশ, যা ৪৪% ভূখণ্ডজুড়ে বিস্তৃত। এই অঞ্চলের মাটির নিচে রয়েছে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, তামা এবং স্বর্ণের সম্পদ। কিন্তু এই সম্পদের ভাণ্ডার থাকা সত্ত্বেও, বেলুচিস্তানের মানুষদের জীবন চলছে বিশাল শূন্যতার মধ্যে।
এটি একটি উপেক্ষিত প্রদেশ, যেখানে শহরগুলোর মানচিত্র উন্মুক্ত থাকলেও, জনগণের জীবন এখনো সেইসব পথে আটকে আছে, যেখানে প্রায় কোনো উন্নয়ন নেই। সড়কগুলোর জায়গায় ধূলিময় পথ, শহরের ভেতরে বিদ্যুৎ ও পানি সংকট এবং সমাজের সর্বক্ষেত্রে অবহেলা—এগুলোই এখানে বসবাসকারী মানুষের সাধারণ অবস্থা।
এখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, সমস্ত ক্ষেত্রেই একটি সাংঘাতিক অপ্রতুলতা রয়েছে। সরকারি পর্যায়ে ন্যায্য দায়িত্ব পালন বা সহায়তা পাওয়া অত্যন্ত কঠিন, বিশেষত বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশেও বিধি-নিষেধ রয়েছে। এছাড়া, অঞ্চলটি অপরাধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে সাধারণ জনগণের চলাচলের জন্যও এক ধরনের বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে।
আজও বেলুচিস্তানে এই পরিস্থিতি চলমান রয়েছে, প্রমাণ করে যে, এই পরিস্থিতি কখনোই দ্রুত পরিবর্তন হবে না। পরিবারগুলো একে অপরের সঙ্গে কথা বলে, স্বপ্ন দেখে, আশাবাদী থাকে, কিন্তু বাস্তবে তারা কেবল নিজেদের হারানো প্রিয়জনের স্মৃতি আর তাদের যন্ত্রণা নিয়েই বেঁচে থাকে।
বেলুচিস্তানের জীবন এখন এক বিরাট অপেক্ষা, যেখানে পরিণতি অজ্ঞাত। কবে আসবে এর সমাপ্তি?
মন্তব্য করুন