৩ বছর আগে ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে। এ ঘটনাটি পাকিস্তানের জন্য ছিল অনেকটা বিজয়ের মতো। পাকিস্তান তখন মনে করেছিল, তালেবান ক্ষমতায় এলে তাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে।
তখন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রাশিদ আহমেদ বলেছিলেন, তালেবানের দ্রুত ক্ষমতা দখল ‘একটি নতুন জোট’ তৈরি করবে, যা পুরো অঞ্চলের জন্য বৈশ্বিক গুরুত্ব সৃষ্টি করবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও তালেবানের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনকে আফগান জনগণের ‘দাসত্বের শিকল ভাঙা’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
তবে, এত মধুর সম্পর্কের পরও পাকিস্তান ও তালেবানের মধ্যে বর্তমানে উত্তেজনা বেড়ে গেছে। ২০২৪ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানে দুবার বিমান হামলা করেছে, যা তাদের সম্পর্কের তিক্ততার একটি বড় উদাহরণ।
পাকিস্তান-তালেবান সম্পর্কের পেছনের ইতিহাস
পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে তালেবানকে আশ্রয় এবং সমর্থন দিয়ে এসেছে। তালেবান ২০০১ সালের পর পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আশ্রয় নেয় এবং সেখানে নিজেদের শক্তি তৈরি করে।
পাকিস্তানের মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে এমনকি তালেবানের বহু নেতা পড়াশোনা করেছে এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন শহর যেমন- কোয়েটা, পেশোয়ার এবং করাচি তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল।
তালেবান ও পাকিস্তানের এই সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক উপকারে, কারণ পাকিস্তান চেয়েছিল আফগানিস্তানে তালেবান শক্তিশালী হলে তাদের প্রভাবও বৃদ্ধি পাবে।
তবে, তালেবান কাবুলে ক্ষমতায় আসার পর তাদের আচরণ পরিবর্তিত হয়েছে। তারা এখন পাকিস্তানের চেয়ে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতে বেশি মনোযোগী এবং পাকিস্তানকেও তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে কম সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে চাইছে।
ডুরান্ড লাইন ও সীমান্ত সমস্যা
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে একটি দীর্ঘদিনের সমস্যার নাম ডুরান্ড লাইন, যা ঔপনিবেশিক যুগে সীমান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পাকিস্তান এই সীমান্তকে আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেয়, কিন্তু আফগানিস্তান কখনোই এই সীমান্তকে স্বীকৃতি দেয়নি।
ক্ষমতায় আসার পর তালেবানও তাদের পূর্বসূরি সরকারের মতো এই সীমান্তকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে। আফগানিস্তানে ডুরান্ড লাইন একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ইস্যু, কারণ এটি দুটি প্রধান পশতুন জাতির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে।
এদিকে পাকিস্তান এই সীমান্তের নিরাপত্তা নিয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, যা আফগানিস্তান ও তালেবানের জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা ও টিটিপি
তালেবান আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলের পর পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা বেড়ে গেছে, বিশেষ করে টিটিপি (তেহরিক ই তালেবান পাকিস্তান) বা পাকিস্তানি তালেবান সদস্যরা এসব হামলার পেছনে রয়েছে। টিটিপি ও আফগান তালেবান দীর্ঘদিন ধরে একে অপরের সহায়তায় অস্ত্র ও কৌশল ভাগাভাগি করেছে।
পাকিস্তান এখন আফগানিস্তানে টিটিপির নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চায়, কিন্তু তালেবান তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান বজায় রাখতে চায় এবং পাকিস্তানের এই দাবি মেনে নিতে রাজি নয়।
তালেবান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, টিটিপি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং পাকিস্তানকেই এটি সমাধান করতে হবে।
পাকিস্তানের সামরিক পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
সম্প্রতি পাকিস্তান আফগানিস্তানে টিটিপির বিরুদ্ধে হামলা চালাতে থাকলে, এটি আফগান জনগণের মধ্যে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব বাড়াবে। পাশাপাশি, আফগানিস্তানে পাকিস্তানের সামরিক কার্যক্রম পাকিস্তানি পশতুনদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
পাকিস্তানও জানে যে, আফগানিস্তানে তাদের প্রভাব বজায় রাখতে এবং টিটিপি প্রতিরোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হলে, সীমান্তে এবং অন্যান্য অঞ্চলে তাদের শক্তি ব্যবহার করতে হবে। তবে, আফগানিস্তানে পাকিস্তান যে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে, তা তাদের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটাচ্ছে।
তালেবান প্রতিরোধের অক্ষমতা
তালেবান এখন পাকিস্তানের এই সামরিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার কথা বললেও, তারা এখনো শক্তিশালী প্রতিবাদ গড়ে তুলতে অক্ষম। তাদের হাতে পর্যাপ্ত সামরিক শক্তি নেই এবং তারা আন্তর্জাতিকভাবেও একা।
আফগানিস্তানের আকাশসীমা এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যা তাদের সেনাবাহিনীকে কিছুটা বাধাগ্রস্ত করে। তালেবান তাদের প্রতিশোধের কথা বললেও, পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ গড়া অনেক কঠিন।
ভবিষ্যতের দিকে
পাকিস্তান ও তালেবান এখন যে সম্পর্কের মধ্যে রয়েছেন, তা দীর্ঘমেয়াদি শান্তির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তান চাইছে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো তাদের সমাধান করতে, কিন্তু তালেবান তাদের স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য পাকিস্তানের চাপ মোকাবিলা করতে চাচ্ছে।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে একসাথে কাজ করতে হবে যদি তারা দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তবে, বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ এই অঞ্চলের ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক সংকেত প্রদান করছে।
উল্লেখ্য, পাকিস্তান এবং তালেবান একসময় মিত্র ছিল, কিন্তু বর্তমানে তাদের মধ্যে সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ এবং জটিল হয়ে উঠেছে। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, সীমান্ত বিতর্ক এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এই সম্পর্ককে আরও তিক্ত করেছে।
দুই দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি সাহসী পদক্ষেপ এবং নেতৃত্বের যোগ্যতা, যা তাদের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং শান্তির পথে এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
সূত্র : আল-জাজিরার হামিদ হাকিমির বিশ্লেষণ থেকে অনুবাদ করা
মন্তব্য করুন