পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের তিন দিন ধরে চলা বিক্ষোভ কর্মসূচি নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক দমনপীড়নের মুখে শেষ হয়েছে।
দলটি তাদের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, বুধবার (২৭ নভেম্বর) ভোরে বিক্ষোভ কর্মসূচি স্থগিত করার ঘোষণা দেয়।
এই বিক্ষোভের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মুক্তি, সরকারের পদত্যাগ এবং সংবিধানের ২৬তম সংশোধনী বাতিলের দাবি তুলে আন্দোলন চালানো।
গত ২৪ নভেম্বর, পিটিআই নেতারা ইসলামাবাদে ‘ডি-চক’ নামক এলাকায় সমাবেশ করতে শুরু করেন। বিক্ষোভের আহ্বান করেছিলেন ইমরান খান, যিনি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। দলটির দাবি ছিল, সরকার তার বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্র বন্ধ করে তাকে মুক্তি দিক, সরকার পদত্যাগ করুক এবং সংবিধানের ২৬তম সংশোধনী বাতিল করা হোক।
এই সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের ক্ষমতা সংসদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, যা পিটিআইয়ের নেতানেত্রীদের বক্তব্য মতে সরকারের একচেটিয়া ক্ষমতার সৃষ্টি করছে।
বিক্ষোভের সময়, দলের নেতারা এবং কর্মীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিভক্তি প্রকাশ করেন। ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবি, যিনি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তার নেতৃত্বে পিটিআইয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে দলের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। দলে অনেক নেতার অভিযোগ, বুশরা বিবির একক সিদ্ধান্তের কারণে আন্দোলনে সঠিক সমন্বয় এবং নেতৃত্বের অভাব ছিল।
সূত্র অনুযায়ী, পিটিআই নেতা ব্যারিস্টার গহর ও ব্যারিস্টার সাইফকে বিশেষভাবে ডি-চকে পৌঁছানোর জন্য হেলিকপ্টারও পাঠানো হয়েছিল, তবে তারা শেষ পর্যন্ত সেখানে পৌঁছানোর আগেই বিক্ষোভকারীরা ইসলামাবাদে পৌঁছে যান। পিটিআই নেতারা বুশরা বিবির একক সিদ্ধান্তের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন, বিশেষ করে বিক্ষোভের পরিকল্পনা এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নে তার নেতৃত্বে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে, পাকিস্তান সরকার বিক্ষোভ দমন করতে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। পুলিশ এবং সীমান্ত রক্ষী বাহিনী রেঞ্জার্স ইসলামাবাদের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ডি-চক এবং রেড জোন এলাকায় ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। এই সংঘর্ষে অন্তত ছয় জন নিহত হন।
নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে বিক্ষোভকারীদের ওপর আক্রমণ করেছে। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন নাকভি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘নিরাপত্তা বাহিনী সাহসিকতার সাথে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে।’ তবে, মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই দমনপীড়নকে বেআইনি এবং অতিরিক্ত বল প্রয়োগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
বিক্ষোভ দমন করার পর, বুশরা বিবি এবং পিটিআইয়ের খাইবার পাখতুনখোয়ার মুখ্যমন্ত্রী আলী আমিন গান্দাপুর ইসলামাবাদ থেকে পালিয়ে যান। পিটিআই নেতারা জানিয়েছেন, তারা একটি গোপন গন্তব্যে চলে গেছেন, যেখানে তাদের অবস্থান নিরাপদ ছিল। খাইবার পাখতুনখোয়ার একটি নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। তবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে দলের মধ্যে নেতৃত্বের সংকট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
পিটিআইয়ের বিক্ষোভ কর্মসূচির বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের তীব্র প্রতিরোধের পরও, দলের একাংশে আলোচনা শুরু হয়েছে। শওকত ইউসুফজাই যিনি পিটিআইয়ের সিনিয়র নেতা এবং সাবেক সাংবাদিক। তিনি বলেন, দলের হাইকমান্ড বিক্ষোভের কর্মসূচিতে যথাযথভাবে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি আরও, ‘এই বিক্ষোভের মাধ্যমে সরকার ও পিটিআই উভয়েরই ক্ষতি হয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বেড়েছে এবং পিটিআইয়ের সদস্যদের ওপর দমনপীড়ন চলছে।’
এদিকে, পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশন এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দ্রুত রাজনৈতিক সংলাপের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা দাবি করেছেন, পাকিস্তান সরকারের উচিত পিটিআই নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসা। উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, এ বিক্ষোভে কেউ বিজয়ী হয়নি। এর ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
এই পরিস্থিতির পর, পিটিআইকে এখন আগামী দিনে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম এবং আন্দোলনের পথ নির্বাচন করতে হবে। বুশরা বিবি ও দলের অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বিভক্তি এবং দলের অভ্যন্তরীণ সংকট দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আরও বড় প্রশ্ন তুলেছে। এই মুহূর্তে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পিটিআইয়ের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে অনেকটাই অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।
পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের সামনে একটি কঠিন পথ অপেক্ষা করছে, যেখানে দলের নেতৃত্ব এবং সরকারের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে।
মন্তব্য করুন