পাকিস্তানের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ২৩ জন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তবে তাদের কেউই ক্ষমতার পূর্ণকাল প্রধানমন্ত্রীর আসন ধরে রাখতে পারেননি। কখনো কেউ সামরিক অভ্যুত্থান, কেউ আবার বিরোধীদলের অনাস্থাসহ নানা কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
দেশটিতে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলী খান। তিনি ১৯৮৭ সালের ১৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। মাত্র ৪ বছর ২ মাস পর ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডিতে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন তিনি।
লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনি ১৯৫১ সালের ১৭ অক্টোবর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবে মাত্র দেড় বছরের মাথায় ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল গভর্নর জেনারেল তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন।
আরও পড়ুন : ইমরান খানের গ্রেপ্তার নিয়ে যা বলল যুক্তরাষ্ট্র
খাজা নাজিমুদ্দিনকে সরিয়ে দেওয়ার পর ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন মোহাম্মদ আলী বগুড়া। তবে ২ বছর ৩ মাসের মাথায় ১৯৫৫ সালের ১২ আগস্ট পদত্যাগে বাধ্য হন।
১৯৫৫ সালের ১২ আগস্ট পাকিস্তানের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত হন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। তবে ১ বছর ১ মাসের মধ্যে ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর দলের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। চৌধুরী মোহাম্মদ আলী পাকিস্তানের সংবিধান সংশোধনীতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এজন্য তিনি পাকিস্তানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।
দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। কিন্তু ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে মতের অমিল হওয়ায় ১ বছর ১ মাসের ব্যবধানে ১৯৫৭ সালের ১৭ অক্টোবর পদত্যাগ করেন।
আরও পড়ুন : যে দুটি পথ খোলা ইমরান খানের
এরপর দেশটিতে মাত্র ২ মাসেরও কম সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দ্রিগার। ১৯৫৭ সালের ১৭ অক্টোবর তিনি প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করেন।
মালিক ফিরোজ খান নুন ছিলেন পাকিস্তানের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী। তবে তিনি ১০ মাসের কম সময় ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৫৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর ফিরোজ খানকে প্রধানমন্ত্রীতে উন্নীত করেন ইস্কান্দার মির্জা। কিন্তু ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে তাকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করেন।
দেশটিতে সবচেয়ে কম সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নুরুল আমিন। তিনি ১৩ বছরের সামরিক আইন জারির পর স্বৈরাশাসক ইয়াহইয়া খানের অধীনে ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী হন। তবে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন : পাঁচ বছর রাজনীতি করতে পারবেন না ইমরান খান
এরপর ১৯৭৩ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন জুলফিকার আলী ভুট্টো। এরপর ১৯৭৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং পুনরায় নির্বাচিত হন। কিন্তু দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলেও তিনি ৫ বছর পূর্ণ করতে পারেননি। মাত্র তিন বছর ১১ মাস ক্ষমতায় ছিলেন। সামরিক অভ্যুত্থানের মুখে কারাবন্দি হন। এরপর ১৯৭৯ সালের ৫ জুন তার ফাঁসি হয়।
এরপর দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন মুহাম্মদ খান জুনেজো। ১৯৮৫ সালের ২৩ মার্চ তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। তিন বছর ২ মাস পর ১৯৮৮ সালের ২৯ মে তাকে বরখাস্ত করা হয়।
দেশটির ইতিহাসে বাবা-মেয়ে দু'জনেই প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়ে বেনজির ভুট্টো ১৯৮৮ সালের ২ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন।
তিনি ১ বছর ৮ মাস ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৮৯ সালে অভিশংসনের মুখে পড়ে তার দল। তবে সে যাত্রায় তিনি রক্ষা পান। এরপর ১৯৯০ সালের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি গুলাম ইসহাক তাকে সরিয়ে দেন।
আরও পড়ুন : মেয়াদ শেষের তিন দিন আগেই সংসদ ভেঙে দেবেন শাহবাজ
বেনজির ভুট্টোর পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরীফ। ১৯৯০ সালের ৬ নভেম্বর দায়িত্ব নেন। কিন্তু ১৯৯৩ সালে তাকে রাষ্ট্রপতি গুলাম ইসহাক তার সরকারকে বরখাস্ত করেন। এরপর সুপ্রিম কোর্ট এ সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করেন। কিন্তু ১৯৯৩ সালের ১৮ জুলাই তিনি ও গুলাম ইসহাক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
এরপর দেশটির প্রধানমন্ত্রীর আসন গ্রহণ করেন নওয়াজ শরীফ। তিনি ১৯৯৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী হন। তবে ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর জেনারেল পারভেজ মোশাররফ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। এ সময় তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। নওয়াজ শরীফ ২ বছর ৮ মাস প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
২০০২ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন মীর জাফরুল্লাহ খান জামালি। তিনি স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফের অধীনে প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু তাকে ২০০৪ সালের ২৬ জুন বরখাস্ত করা হয়।
চৌধুরী সুজাত ছিলেন জাফরুল্লাহ খানের পরবর্তী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি মাত্র ২ মাস দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শওকত আজিজ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ের জন্য তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
শওকত আজিজ তিন বছর দুই মাসের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ২০০৪ সালের ২৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। এরপর ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সংসদের মেয়াদ শেষ হলে তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেন।
দেশটিতে শওকত আজিজের পর ২০০৮ সালের ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী হন ইউসুফ রাজা গিলানি। নির্বাচনে তার দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তবে ২০১২ সালে শীর্ষ আদালত অবমাননার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি চার বছর এক মাস ক্ষমতায় ছিলেন।
ক্ষমতার অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন রাজা পারভেজ আশরাফ। তিনি ২০১২ সালের ২২ জুন থেকে ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার মেয়াদকাল ছিল মাত্র ৯ মাস।
২০১৩ সালের ৫ জুন পঞ্চমবারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরীফ। তিনি দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তবে কোনোবারই তিনি মেয়াদকাল পূর্ণ করতে পারেননি। ২০১৭ সালের ২৮ জুলাই সর্বোচ্চ আদালতে অভিশংসনের মাধ্যমে তার পতন হয়। এ সময় তিনি চার বছর ২ মাস ২৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন।
নওয়াজ শরীফ অভিশংসিত হওয়ায় পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন শাহীদ খাকান আব্বাসি। তিনি ২০১৭ সালের আগস্টে ২১ তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় ২০১৮ সালের ৩১ মে সংসদ ভেঙে দিলে তার শাসনকাল শেষ হয়। তিনি এক বছরেরও কম সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল জাতীয় পরিষদের অনাস্থা ভোটে ক্ষমতা হারান। তোশাখানা থেকে উপহারের তথ্য গোপন ও কম দামে বিক্রির অভিযোগে গত শনিবার (৫ আগস্ট) তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ইসলামাবাদের একটি আদালত।
দেশটির ২৩তম ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ। তিনি ২০২২ সালের ১১ এপ্রিল ক্ষমতা গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন। আগামী ৯ আগস্ট সংসদ ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
মন্তব্য করুন