বাংলাদেশের উন্নয়নের এক অন্যতম অংশীদার চীন। একইসঙ্গে চীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে দুদেশের এই ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও মজবুত হচ্ছে। সামরিক দিক থেকেও ঢাকার সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্ক ব্যাপক যা দিনে দিনে আরও বাড়ছে। চীনের সাথে বাংলাদেশের এই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক এখন ভারতসহ প্রতিবেশী অনেক দেশের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়তে পারে।
১৯৭৫ সাল থেকে চীন বাংলাদেশের আধুনিক কূটনৈতিক সম্পর্কের শুরু। এই সম্পর্কের সূচনা করেছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালের শেষে ও ১৯৭৬ সালের শুরুতে চীন–বাংলাদেশ সম্পর্কের যে ভিত্তি রচিত হয়েছিল তার প্রধান অবলম্বন ছিল নিরাপত্তা ইস্যু।
শুরুতে ঢাকা বেইজিং সম্পর্ক সামরিক-রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে বৃত্তাবদ্ধ ছিল। ফলে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের প্রাথমিক সূত্র তৈরি হয় অস্ত্র সরবরাহের মধ্য দিয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ সম্পর্ক বাণিজ্যসহ নানামুখী অংশীদারত্বের সম্পর্কে পৌঁছায়। পাশাপাশি বাংলাদেশ চীনের জন্য হয়ে ওঠে আঞ্চলিক রাজনীতির অন্যতম ভারসাম্য বিন্দু। ফলে বেইজিং সবসময় ঢাকাকে কাছে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে।
৫ আগস্ট হাসিনার পতন হওয়া মাত্রই চীন নবগঠিত ইউনূস সরকারের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষমতা গ্রহণের পর গত ১২ অক্টোবর দুটি চীনা যুদ্ধজাহাজ শুভেচ্ছা সফরে বাংলাদেশ ঘুরে যায়। হাসিনার পতনের পর চীনা কর্তৃপক্ষ হাসিনাবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করতে থাকে।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় আলামত হলো, প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের আসন্ন চীন সফর। আগামীকাল ২৬মার্চ চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে চীন যাচ্ছেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টার এই সফরকে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই সফরে দেশটির সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার পাশাপাশি গুরুত্ব পেতে পারে তিস্তা ইস্যুও।
ড. ইউনূসের এই চীন সফরকে সামরিক দিক দিয়েও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বসে তিনি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা অর্জনে সহযোগিতার গ্যারান্টি নিয়ে আসবেন। পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এরইমধ্যে বলেছেন, ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, যা অন্তর্বর্তী সরকার অব্যাহত রাখতে চায় বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দুই দেশের সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রতিরক্ষা। বাংলাদেশের সমরাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী চীন। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে চীন। ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে চীনের কাছ থেকে আরও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ।’
সামরিক দিক থেকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সমরাস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জামের বেশিরভাগই আসে চীন থেকে। প্রতিরক্ষা খাতবিষয়ক আন্তর্জাতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক সুইডেনের স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের আমদানি করা সমরাস্ত্রের ৭২ শতাংশই এসেছে চীন থেকে। আর সামরিক বাহিনীর প্রায় ৭৫ শতাংশ লজিস্টিক সাপোর্ট চীন থেকে আমদানি করা হয়।
শুধু সেনাবাহিনীই নয়, বাংলাদেশের নৌবাহিনীর বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বেইজিং। যার উদাহরণ চট্টগ্রামে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র সাবমেরিন ঘাঁটি, যেখানে ছয়টি সাবমেরিনের পাশাপাশি আটটি যুদ্ধজাহাজ অবস্থান করতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্ত হওয়া দুটি সাবমেরিনের সরবরাহকারীও চীন।
এদিকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে বেইজিং নতুন নতুন ক্ষেত্রে ঢাকার সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে আগ্রহী বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওবায়দুল হক।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে তো একটা রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে। তাই চীনের জন্য একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে, তারা এ সুযোগটা নিতে চায়। বাংলাদেশের সঙ্গে আরও কোথায় কোথায় এনগেজমেন্ট বাড়ানো যায়, সেগুলোর সন্ধান করছে তারা। যেসব জায়গায় ধরুন অ্যাপ্লিকেশনস আছে, সেসব জায়গায় চীন যুক্ত হতে চাচ্ছে। তাদেরও বাংলাদেশকে নিয়ে একটা ভূরাজনৈতিক স্বার্থ আছে আমরা জানি, তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ অবস্থাটা কাজে লাগাচ্ছে তারা।’
সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা গেছে, বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের সামরিক প্রযুক্তি হস্তান্তর করেছে চীন। এর মাধ্যমে দেশীয় প্রতিরক্ষা শিল্প ঘাঁটি (ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেস) গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের আগে বাংলাদেশ ও চীনের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক নিয়ে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়। সবমিলে মনে হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর সামরিক শক্তি অর্জনের দুয়ার খুলছে বাংলাদেশের সামনে।
মন্তব্য করুন