বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ-সংঘাত এবং অন্যান্য মানবসৃষ্ট সংকট আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এক বিশাল হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
এই বিপর্যয়গুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, তার এক বাস্তব উদাহরণ হলো নরওয়ের আর্কটিক অঞ্চলে স্থাপিত ‘ডুমস ডে ভল্ট’, যা বিশ্বের বীজ সংরক্ষণের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত।
এই ভল্টের ধারণা নূহ (আ.)-এর সময়ের মহাপ্লাবনের সঙ্গে চমৎকারভাবে মিলে যায়, যেখানে পৃথিবীজুড়ে সব প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করার এক মহৎ উদ্দেশ্য ছিল।
ডুমস ডে ভল্ট : মানবসভ্যতার ভবিষ্যতের আশ্রয়স্থল
ডুমস ডে ভল্ট, যার আনুষ্ঠানিক নাম 'স্ভালবার্ড গ্লোবাল সিড ভল্ট', ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নরওয়ের স্ভালবার্ড দ্বীপপুঞ্জের স্পিটসবার্গেন দ্বীপে যাত্রা শুরু করে। এটি একধরনের বৈশ্বিক বীজ ব্যাংক, যা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ফসলের বীজ সংরক্ষণ করে, যেন যেকোনো বৈশ্বিক বিপর্যয়ের পর কৃষিব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়।
এই ভল্টটি একটি অত্যন্ত নিরাপদ স্থানে পর্বতের ৪৩০ ফুট গভীরে নির্মিত, যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূমিকম্প, পারমাণবিক বিস্ফোরণ, এমনকি মহাজাগতিক ঘটনা থেকেও এটি সুরক্ষিত।
এটি প্রায় ৪৫ লাখ বিভিন্ন জাতের বীজ সংরক্ষণ করতে সক্ষম এবং এর তাপমাত্রা মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখা হয়, যাতে বীজগুলোর জীবনীশক্তি দীর্ঘ সময় অক্ষুণ্ন থাকে। গত ফেব্রুয়ারির শেষে ভল্টে ১৪ হাজার নতুন বীজের নমুনা যুক্ত করা হয়েছে। ফলে মোট সংরক্ষিত বীজের সংখ্যা ১১ লাখের বেশি হয়েছে।
এই সংরক্ষিত বীজগুলোর মধ্যে গম, ভুট্টা, ধান, আলু এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ফসলের বীজ রয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী কৃষি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে।
মহাপ্লাবনের মিল : নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবন ও ডুমস ডে ভল্টের ধারণা
পবিত্র কোরআনে নূহ (আ.)-এর সময়ের মহাপ্লাবনের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে আল্লাহর নির্দেশে নূহ (আ.) একটি বিশাল নৌকা নির্মাণ করেন এবং প্রতিটি প্রাণী ও প্রাণিকুলের একটি করে জোড়া এই নৌকায় তোলেন।
পৃথিবীজুড়ে পানির তোড়ে যখন সবকিছু তলিয়ে যায়, তখন এই নৌকা একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে এবং প্রাণিজগতের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। এই প্লাবনের ঘটনা কেবল ইসলামই নয়, খ্রিস্টধর্ম ও ইহুদি ধর্মেও উল্লেখিত রয়েছে।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে, মহাপ্লাবনের সময় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রজাতি সংরক্ষণ করার ধারণা এবং ডুমস ডে ভল্টে একইভাবে পৃথিবীর কৃষি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ধারণা অনেকটা এক ধরনের মিল পাওয়া যায়।
ডুমস ডে ভল্টে আজকের বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ফসল ও কৃষিজ সম্পদ সংরক্ষিত হয়, ঠিক যেমন নূহ (আ.)-এর নৌকায় পৃথিবীর সব প্রাণী সংরক্ষিত হয়েছিল। ডুমস ডে ভল্টের কার্যক্রম একধরনের আধুনিক মহাপ্লাবন প্রস্তুতির মতো, যা মানবসভ্যতার বিপর্যয়ের পর কৃষি পুনরুদ্ধার এবং খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় সহায়তা করবে।
একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ
ডুমস ডে ভল্ট শুধু একটি বীজ সংরক্ষণাগার নয়, এটি মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ রক্ষার একটি মহৎ প্রচেষ্টা। জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যদি কৃষিব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়, তবে এই ভল্ট থেকে সেগুলো পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।
এটি পৃথিবীর প্রতিটি দেশে খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষির টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
একটি ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ডুমস ডে ভল্টের ধারণা মহাপ্লাবনের সঙ্গে চমৎকারভাবে সংযুক্ত। এর মাধ্যমে পৃথিবীজুড়ে কৃষি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের যে প্রচেষ্টা চলছে, তা ভবিষ্যতের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র : টাইম ম্যাগাজিন
মন্তব্য করুন