বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ইতিহাসের অন্যতম কঠিন সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। সদ্য পুনর্নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে একাধিক দেশ সদস্যপদ প্রত্যাহার করায় সংস্থাটির নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার প্রশ্নে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইতালি, আর্জেন্টিনা, হাঙ্গেরি, এমনকি রাশিয়া ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশও সদস্যপদ পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব দেশের অভিযোগ, ডব্লিউএইচও তার মূল জনস্বাস্থ্য এজেন্ডা থেকে সরে এসেছে এবং রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করছে।
গত ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। সংস্থার কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়নে ব্যর্থতা, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা এবং নির্দিষ্ট কিছু সদস্য রাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে নতি স্বীকার করার কারণে মার্কিন প্রশাসন থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ছিল ডব্লিউএইচও-এর বৃহত্তম অর্থায়নকারী দেশ, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত ৬.৮ বিলিয়ন ডলার বাজেটের ২২% অনুদান যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসার কথা ছিল। তবে আকস্মিক এই প্রত্যাহার আদেশ সংস্থাটিকে মারাত্মক আর্থিক সংকটের মুখে ফেলেছে, যা এর কার্যক্রম ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্য উদ্যোগের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী দ্রুত প্রধান শিরোনামে পরিণত হয়েছে। ইতালির উপপ্রধানমন্ত্রী মাতেও সালভিনি অবিলম্বে একটি আইন প্রস্তাব করেন, যাতে ইতালিও একই পথ অনুসরণ করতে পারে। তিনি ডব্লিউএইচও-কে জাতীয় জনস্বার্থের চেয়ে বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর স্বার্থরক্ষাকারী সংস্থা হিসেবে আখ্যা দেন। সংস্থাটির রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকার প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থান এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে এর এক সপ্তাহের মধ্যেই আর্জেন্টিনা ডব্লিউএইচও থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এদিকে হাঙ্গেরিও তাদের সদস্যপদ পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দিয়েছে। দেশটির সরকারি মন্ত্রীদের বক্তব্য, যদি যুক্তরাষ্ট্র ডব্লিউএইচও থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, তাহলে হাঙ্গেরিকেও নিজেদের স্বার্থ পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।
এদিকে রাশিয়া ও যুক্তরাজ্যও ডব্লিউএইচও নিয়ে বিতর্কে যুক্ত হয়েছে। রুশ রাজনীতিবিদ পিওতর টলস্টয় সংস্থাটির কর্মকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়ে রাশিয়ার সদস্যপদ স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যে নাইজেল ফারাজের সংগঠন অ্যাকশন অন ওয়ার্ল্ড হেলথ (এডব্লিউএইচ) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সংস্কার বা বিকল্প সংস্থা গঠনের সম্ভাবনা নিয়ে ‘বেল রিভিউ’ নামে একটি মূল্যায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
ডব্লিউএইচও-এর কার্যক্রম নিয়ে কড়া নজরদারির কারণে সংস্থাটির ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)-ও বিতর্কের মুখে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিগুলো তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত এই এফসিটিসি’কে গোপনীয়তা বজায় রাখা এবং বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠীর প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার অভিযোগে সমালোচিত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা তামাকজনিত ক্ষতি হ্রাসের নীতিতে এফসিটিসি-এর অবস্থানের কড়া সমালোচনা করেছেন, কারণ সংস্থাটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত কম ক্ষতিকর নিকোটিন বিকল্পগুলোর কার্যকারিতা সরাসরি অগ্রাহ্য করেছে।
রোমানিয়া, পর্তুগাল, চেক রিপাবলিক, পোল্যান্ড ও স্লোভাকিয়ার বিভিন্ন গণমাধ্যম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং এর এফসিটিসি-তে মার্কিন বিলিয়নিয়ার ও দাতব্যকর্মী মাইকেল ব্লুমবার্গের প্রভাব নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছে। সমালোচকদের দাবি, ব্লুমবার্গের অর্থায়নের ফলে ডব্লিউএইচও-এফসিটিসি নিকোটিন বিকল্পগুলোর বিরুদ্ধে অতি কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে। এর ফলে বাস্তবসম্মত জনস্বাস্থ্য সমাধানের পরিবর্তে তামাকের বিরুদ্ধে আদর্শিক বিরোধিতাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী নিকোটিন ও তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিতে মার্কিন বিলিয়নিয়ার মাইকেল ব্লুমবার্গের হস্তক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিভিন্ন দেশে ব্লুমবার্গের অর্থায়নে পরিচালিত সংস্থাগুলোর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ভারতে অর্থায়নের প্রকৃত উৎস ঘোষণা না করায় ব্লুমবার্গ-অর্থায়িত একটি তামাক নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে নিষিদ্ধ করা হয়। ভিয়েতনামে, ডব্লিউএইচও-এর কর্মকর্তারা ব্লুমবার্গের অবদানকে প্রকাশ্যে প্রশংসা করলেও অভিযোগ উঠেছে, তামাকজনিত ক্ষতি হ্রাস নীতির মাধ্যমে সফলভাবে ধূমপান ছেড়েছেন এমন লাখো মানুষের কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষা করা হয়েছে। ফিলিপাইনে, আইনপ্রণেতারা বিদেশি অনুদানের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা এটিকে জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
জেনেভায় অনুষ্ঠিত ডব্লিউএইচও এফসিটিসি-এর ১১তম সম্মেলন (কপ ১১)-এ সদস্য দেশগুলোকে ন্যায্য সংস্কারের জন্য ব্যাপক চাপ দেওয়া হয়েছে। দেশগুলোকে বলা হয়েছে, তারা যেন প্রভাবশালী দাতাদের ব্যক্তিগত এজেন্ডার চেয়ে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। বিশ্বব্যাপী একটি সঙ্গতিপূর্ণ মতামত তৈরি হচ্ছে যে, যদি ডব্লিউএইচও ও এফসিটিসি স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং তামাকজনিত ক্ষতি হ্রাস বিষয়ক উদ্বেগগুলো সমাধান না করে, তবে আরও দেশ সদস্যপদ প্রত্যাহার করবে এবং নতুন একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গঠন হবে।
বর্তমান সংকট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এটি স্পষ্ট নয় যে, সংস্থাটি সংস্কারের আহ্বানগুলো গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করবে নাকি আরও বিভক্ত হবে। তবে যা স্পষ্ট তা হলো, ডব্লিউএইচও ও এর নীতিগুলোর প্রতি অন্ধবিশ্বাসের দিন হয়তো শেষ হতে চলেছে।
মন্তব্য করুন