প্রায় তিন সপ্তাহ আগে রহস্যজনক এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হন ইব্রাহিম রাইসি। তার মৃত্যুর পর অভিযোগের তীর ধেয়ে যায় ইসরায়েলের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের দিকে। ইরানের মাটিতে বসেই ভয়াবহ সব মিশন চালানোর জন্য মোসাদের জুড়ি নেই। এর আগেও বেশ কয়েকজন হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিকে আততায়ী হামলায় হত্যা করেছে মোসাদ। কীভাবে এতটা নিখুঁতভাবে এবং নির্বিঘ্নে মোসাদ ইরানে তার মিশন চালায় তা বরাবরই আগ্রহের জন্ম দিয়েছে।
আমেরিকান থিংক ট্যাংক আটলান্টিক কাউন্সিলে এক নিবন্ধে ইরানে মোসাদের কয়েক মিশনের বর্ণনা তুলে ধরেন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক স্কলার আরাশ আজিজি। ঠিক এক বছর আগে জুন মাসে অবিশ্বাস্য এক দাবি করে বসে মোসাদ। গোয়েন্দা সংস্থাটি দাবি অনুযায়ী ইরানের ভেতর থেকে একজন হিটম্যানকে অপহরণ করেছে তারা। ওই হিটম্যানের টার্গেট ছিল সাইপ্রাসের ইসরায়েলিরা। আর তাকে নাকি নিয়োগ দিয়েছে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী- আইআরজিসি। মোসাদের এমন দাবির স্বপক্ষে তারা ওই ব্যক্তি জবাববন্দির একটি ভিডিও প্রকাশ করে। এরপরই বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
জবানবন্দির ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে মোসাদ দাবি করে, ওই ব্যক্তির নাম ইউসুফ শাহবাজি আব্বাসালিলু। তিনি তুরস্কের ইস্তাম্বুল থেকে ইরান সফর করেছেন। তখনই প্রশ্ন উঠেছিল মোসাদের দাবি যদি সত্য তাহলে শুধু গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহই নয় ইরানের মাটিতে বসেই খুব সহজে গ্রেপ্তার এবং জিজ্ঞাসাবাদ করতে সক্ষম গোয়েন্দা সংস্থাটি। শাহবাজি কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তারা কি কি নির্দেশ দিয়েছেন, মোসাদের জিজ্ঞাসাবাদ, তা সব স্বীকার করেন তিনি।
শুধু শাহবাজই নয়, ২০২২ সালের এপ্রিলে ইসরায়েলি মিডিয়া জানায়, ইরানের মাটিতে আইআরজিসির ৫২ বছর বয়সী একজন এজেন্ট মানসুর রাসৌলিকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে মোসাদের গোয়েন্দারা। রাসৌলির বাসায় করা ওই জিজ্ঞাসাবাদে তিনি তুরস্কে একজন ইসরায়েলি কূটনীতিক, জার্মানিতে একজন মার্কিন জেনারেল এবং ফ্রান্সে এক সাংবাদিককে হত্যার পরিকল্পনার কথা স্বীকার করেন। কোনো সূত্রের উল্লেখ না করে ইসরায়েলি গণমাধ্যম রাসৌলির স্বীকারোক্তির একটি অডিও প্রকাশ করে।
এর কয়েক মাস পরের ঘটনা। ২০২২ সালের জুলাই মাসে লন্ডনভিত্তিক স্যাটেলাইট চ্যানেল ইরান ইন্টারন্যাশনাল জানায়, ইয়াদোল্লাহ খেদমাতি নামে আইআরজিসি’র আরেকজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে মোসাদ। ওই জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি সিরিয়া, ইরাক, লেবানন ও ইয়েমেনে অস্ত্র হস্তান্তরের বিষয়ে স্বীকার করেছেন বলে দাবি করা হয়। এই তিন ঘটনাতেই ব্যাখ্যা দেয় ইরান। খেদমাতি ঘটনায় তিনি একজন আইআরজিসির কর্মকর্তা উল্লেখ করে, তাকে নির্যাতন করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছে বলে তেহরান দাবি করে।
বছরের পর বছর ইরান ও ইসরায়েলের এক ছদ্ম যুদ্ধ চলছে। গোয়েন্দা মিশন, আততায়ী হামলা এবং স্থল ও সমুদ্র অভিযান এর অন্তর্ভুক্ত। জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে আইআরজিসি বা ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সিনিয়র কর্মকর্তাদের আততায়ী হামলায় হত্যার সঙ্গে মোসাদের নাম জড়িয়ে আছে। ২০২০ সালের নভেম্বরে আইআরজিসির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মোহসেন ফাখরিজাদেহকে একটি রোবটিক মেশিন গান দিয়ে হত্যা করা হয়। এর আগে ২০১৮ সালে ইরানের পরমাণু আর্কাইভের ৫৫ হাজার পৃষ্ঠার নথি ও ১৮৩টি সিডি দেশটির এক গ্রাম থেকে জব্দ করে মোসাদ।
নাকের ডগায় বসে একের পর এক দুঃসাহসী মিশন চালালেও মোসাদের কিছুই করতে পারেনি ইরান। উল্টো তুরস্কে ইসরায়েলিদের অপহরণ বা হত্যার মতো ইরানি পরিকল্পনা আঙ্কারা নিয়ে ভেস্তে দেয় তেল আবিব। ইসরায়েল তখন তুরস্কে অবস্থানরত দেশটির নাগরিকদের ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখতে বলে, এমনকি ফুড ডেলিভারির সময়ও দরজা না খোলার নির্দেশ দিয়েছিল তেল আবিব। ওই বছর আইআরজিসির গোয়েন্দা বিভাগের প্রভাবশালী প্রধান হোসেইন তায়েবকে সরিয়ে দেয় ইরান। তার চোখের সামনেই মোসাদ মিশন চালাচ্ছে, তার তিনি কিছু করতে পারছেন, এমন অভিযোগে চাকরি হারান তায়েব।
মন্তব্য করুন