যুক্তরাষ্ট্রপন্থি সরকারকে উৎখাত করে ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশটিকে এক দণ্ডও শান্তিতে থাকতে দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র।
ইরানের আশপাশের বিভিন্ন দেশে ঘাঁটি গেড়ে এবং বিভিন্ন আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ দিয়ে বারবার চাপে রেখেছে তেহরানকে।
ইরানের সদ্য প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পেছনেও পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে।
ইরানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বা হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা নতুন কিছু নয়। ৪৫ বছর আগে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর দেশটির সব সরকারপ্রধানকেই কোনো না কোনো সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে।
কেউ ক্ষমতায় থাকতেই হারিয়েছে প্রাণ বা হয়েছেন রাজনীতির শিকার। আবার কারাবাস থেকে শুরু করে দেশ ছাড়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতার অনুমোদন না থাকায় পুনর্নির্বাচনও করতে পারেননি অনেক প্রেসিডেন্ট।
ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানের প্রথম অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মেহেদি বাজারগান।
অভিযোগ রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আরও বেশি ক্ষমতা চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কঠোর অনুশাসন মেনে চলা ইরানে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতাই সর্বেসর্বা। তাই বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন বাজারগান। পদত্যাগের পর দেশবাসীর উদ্দেশে এক বার্তায়, সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার কাছে নিজেকে কতটা ছোট মনে হয়েছিল সেই কষ্টের কথা তুলে ধরেন।
ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনির সমর্থন নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন আবুল হাসান বনি সদর। কিন্তু ইরাক যুদ্ধে সামরিক বাহিনী ও ইসলামী বিপ্লবী গার্ড আইআরজিসির ভূমিকা নিয়ে বনি সদর ও ইসলামিক রিপাবলিক পার্টির মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়।
এর জেরেই ১৯৮১ সালে ইরানের প্রথম রাষ্ট্রপতি বনি সদরকে ‘রাজনৈতিক অযোগ্যতার’ ভিত্তিতে ইমপিচ বা অভিশংসন করা হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে ফ্রান্স পালিয়ে যান বনি সদর। বাকি জীবনটা সেখানেই কাটিয়ে দেন তিনি।
বনি সদরকে বরখাস্ত করার পর মোহাম্মদ আলি রাজাই ইরানের প্রেসিডেন্ট হন। তবে ক্ষমতা গ্রহণের এক মাসের মধ্যেই বোমা হামলায় প্রাণ হারান তিনি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ওই বিস্ফোরণে তৎকালীন ইরানি প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ জাওয়াদ বাহনারও মারা যান।
এই হামলার জন্য পিপলস মোজাহেদিন অর্গানাইজেশনকে দায়ী করেছিল ইরান। তবে সংগঠনটি কখনো তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ স্বীকার করেনি। আলি রাজাইয়ের পর প্রেসিডেন্ট হন সৈয়দ আলী হোসেইনি খামেনি।
১৯৮০-র দশকে সংবিধান সংশোধনের আগে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন মীর হুসেন মোসাভি। কিন্তু সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার সঙ্গে মতবিরোধের জেরে একবার পদত্যাগও করেছিলেন তিনি। এরপর রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে ২০ বছর আড়ালে ছিলেন মোসাভি।
২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করলেও মাহমুদ আহমাদিনেজাদের কাছে হেরে যান। পরে সরকারবিরোধী গ্রিন মুভমেন্টে জড়িয়ে গৃহবন্দি হন মোসাভি। আরব বিশ্বে অস্থিরতার পর ২০১৩ সালে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারেই আছেন তিনি।
আকবর হাশেমি রাফসানজানি ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তাকে খোমেনির পর ইরানের সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হয়। 'অভিজাত ও মুক্ত বাজার নীতির' কারণে খামেনির বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন রাফসানজানি।
২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়িয়ে হেরে যাবার পর ২০১৩ সালে ফের মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ইরানের গার্ডিয়ান কাউন্সিল তার মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান করে। ২০১৭ সালে রাফসানজানির রহস্যজনক মৃত্যু হয়। তার শরীরে স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি তেজস্ক্রিয়তা পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ খাতামি ১৯৯৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে মেয়াদের প্রথম কয়েক মাস যেতেই ইরানের সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে খাতামি প্রশাসনের বিরোধ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
২০০৪ সালের সংসদীয় নির্বাচনের ফলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ঘটনার পর, ইরানে খাতামির ছবি প্রকাশ নিষিদ্ধ করা। তার দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় বলে জানায় ফার্স নিউজ এজেন্সি।
মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইরানের রাগী এই নেতার সঙ্গে খামেনি ও তার ঘনিষ্ঠদের 'রাজনৈতিক বন্ধুত্ব' বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ২০০৯ সালেও প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর শপথ অনুষ্ঠানে প্রথা ভেঙে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার হাতের পরিবর্তে কাঁধে চুম্বন করেন তিনি।
এরপর আহমাদিনেজাদের একের পর এক সিদ্ধান্ত খামেনির বিরক্তিই বাড়িয়েছে। তারপরও নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে চাইলে গার্ডিয়ান কাউন্সিল আহমাদিনেজাদের প্রার্থিতা প্রত্যাখ্যান করে।
২০১৩ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন হাসান রুহানি। তাকে সবচেয়ে 'সুরক্ষিত' রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মেয়াদের শুরু থেকেই খামেনির আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেন রুহানি।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা এবং জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) নামে আরেকটি চুক্তির জন্য খামেনির তোপের মুখে পড়েছিলেন তিনি। রুহানি ও স্বজনদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
মন্তব্য করুন