ইসরায়েলে প্রথমবারের মতো নজিরবিহীন হামলা চালায় ইরান। এরপর থেকে গোটা বিশ্বের নজর ইসরায়েলের দিকে। আগ্রাসী এ দেশটি এখনো কোনো সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তবে প্রতিশোধের স্পৃহা পুরোপুরি বাদও দিচ্ছে না তারা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, ইসরায়েল ইরানে হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ জন্য তাদের মিত্রদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এতে সায় মিলছে না।
ইরানের হামলার পরই হুংকার থেমে যায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের। দেশগুলো তখনই আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে জানায়, ইসরায়েলকে সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রাখা হবে। কিন্তু এ হামলার প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা কোনো সামরিক পদক্ষেপ নিলে ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়া হবে না।
ইসরায়েলের মিত্র দেশগুলোর এ ধরনের সুরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে। তেমনি বিশ্বজুড়ে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
আদৌ কি পাল্টা হামলা করবে ইসরায়েল?
তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলুর প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের নজিরবিহীন হামলার জবাব দিতে দেশটির ওপর সম্ভাব্য হামলার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে ইসরায়েলের বিমানবাহিনী। সোমবার (১৫ এপ্রিল) ইসরায়েলি স্থানীয় গণমাধ্যমেও এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ হয়।
তবে ইসরায়েলের পাল্টা হামলা নিয়ে ধোঁয়াশা দেখা দিয়েছে। কারণ, মিত্ররা ইসরায়েলকে শুরু থেকেই শান্ত রাখতে চাইছে। ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেনসহ ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্ররা দেশটিকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাখোঁ, জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক ও ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের বক্তব্য পৃথকভাবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসেছে। তাদের সবার বক্তব্যের সারাংশ ছিল, নতুন করে যুদ্ধ চান না তারা। এ কারণে ইসরায়েলকে সংঘাত এড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রও শুরু থেকে ইসায়েলকে পাল্টা সামরিক পদক্ষেপ নিতে নিষেধ করে আসছে।
অপরদিকে ইরানের সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। দেশ দুটি জানিয়েছে, সংঘাত বাড়লে কারও লাভ হবে না। সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ইসরায়েলকে শান্ত থাকতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সোমবার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এ কথপোকথনে ইরানের সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে চীনের সমর্থন রয়েছে শক্ত মন্তব্য এসেছে।
যেমন হবে ইসরায়েলের প্রতিশোধ
ইসরায়েলের সরকারি সম্প্রচার মাধ্যম কেএএন জানিয়েছে, তেল আবিব একটি সীমিত জবাব দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এর ফলে হামলার ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিতে পারবে তেহরান। এ ছাড়া সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়ানো যাবে।
সম্প্রচার মাধ্যমটি বলছে, ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকাকে প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে রাখতে চাইছে ইসরায়েল। তাই নতুন করে দ্বিতীয় আর কোনো যুদ্ধ ফ্রন্ট খুলতে চায় না দেশটি।
ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলাটির ধরন কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়েছে কেএএন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের ভেতরে গুপ্ত হত্যাকাণ্ড বা বড় ধরনের সাইবার হামলা করতে পারে তেল আবিব।
সোমবার ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর প্রধান বলেছেন, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার জবাব দেবে তার দেশ। যদিও মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে যুদ্ধ এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্ররা জবাব দেওয়া থেকে বিরত থাকতে তেল আবিবকে চাপ দিয়ে আসছে।
উভয়পক্ষই শান্ত হওয়ার ইঙ্গিত
ইরানের হামলা প্রাথমিকভাবে ভয়াবহ মনে হলেও তা খুব একটা সফল হয়নি। কারণ, ইসরায়েলে পৌঁছার আগেই অনেক ড্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্র ভূপাতিত করা হয়।
এ প্রেক্ষিতে গবেষণা কেন্দ্র ইউএস ইনস্টিটিউট অব পিস-এর মিডল ইস্ট অ্যান্ড নর্থ আফ্রিকা স্টাডিজ-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট মোনা ইয়াকুবিয়ান বলেছেন, এই মুহূর্তে ইরান ও ইসরায়েল উভয় বিজয় দাবি করতে পারে। তারা খাদের কিনারা থেকে সরে এসেছে। বিশেষ করে যেহেতু ইসরায়েলের কোনো বেসামরিক লোক মারা যায়নি তাই ইসরায়েল নিজেকে শান্ত রাখতে পারে।
তিনি আরও বলেছেন, ইরান দামেস্কে হামলার প্রতিশোধ নিয়েছে। সে সঙ্গে ইসরায়েলকে আরও হামলার জন্য উসকে দেওয়ার মধ্যে ভারসাম্য রাখতে সক্ষম হয়েছে। ইরানও সংঘাত এড়াতে চাইছে বলে মত তার।
ইসরায়েলের সঙ্গে আরবদের ঘনিষ্ঠতা
এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলকে যেহেতু জর্ডান, সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি দেশ সরাসরি সহযোগিতা করেছেন সেহেতু ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়বে।
ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সদস্য বেনি গ্যান্টজ একটা আঞ্চলিক জোট গঠনের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা ইরানের কাছ থেকে একটি শোধ আদায় করব। যার সময় এবং পদ্ধতি আমাদের সুবিধা অনুযায়ী হবে।
এদিকে সুইডিশ ডিফেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাটেজিক উপদেষ্টা ম্যাগনুস র্যানস্টরপ বলেন, ‘এটা ছিল একটা সাবধানতা বার্তা, যার সারমর্ম ছিল ইসরায়েল যদি নিয়ম ভঙ্গ করে তাহলে তার পরিণতি থাকবে।’
না কি ভয়াবহ সংঘাত
ইরানের হামলা ঘিরে নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে হিজবুল্লাহ। তারা ইসরায়েলে হামলা চালাচ্ছে। চলতি সপ্তাহেই লেবানন সীমান্তে হামলায় ইসরায়েলের চার সেনা আহত হন। এর দায় স্বীকার করে সংগঠনটি।
হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইরানের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। সংগঠনটির সামরিক কার্যক্রমের জন্য ইসরায়েল বারবার ইরানকে দোষারোপ করে।
বর্তমানে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে হিজবুল্লাহ রকেট নিক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে। এ নিয়ে ইসরায়েল ক্ষুব্ধ। এদিকে ইয়েমেনের হাউছিরা লোহিত সাগরে তৎপর হয়ে উঠেছে।
ইসরায়েল তাদের নিরাপদ রাখতে এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে আরও জোরাল পদক্ষেপ নিতে পারে। এতে পুরো অঞ্চল আরও অস্থিতিশীল হয়ে যাবে।
মন্তব্য করুন