ইসরায়েল-ফিলিস্তিন চলমান দ্বন্দ্বে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ ইসরায়েলি নাগরিকরা। তেল আবিবে ইউরোপিয়ান অ্যাম্বাসিগুলোতে ইসরায়েলি নাগরিকদের দীর্ঘ লাইন দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমা পর্যটনবিষয়ক অফিসগুলোর দেওয়া তথ্যমতে, সম্প্রতি ইসরায়েলি পাসপোর্টের পাশাপাশি অন্যান্য পশ্চিমা দেশের পাসপোর্ট নেওয়ার আগ্রহ বেড়ে গেছে। মিডল ইস্ট মনিটরের এক প্রতিবেদনে সম্প্রতি এমন সব তথ্য উঠে এসেছে।
পর্তুগিজ ইমিগ্রেশন সার্ভিস জানিয়েছে, বছরের শুরুতে সম্প্রতি ২১ হাজার ইসরায়েলি দেশটির নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছেন। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইমিগ্রেশন কার্যালয়গুলো এখন হাজারো ইসরায়েলির নিত্যকার গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। ফ্রেঞ্চ, পর্তুগিজ, জার্মান এবং পোলিশ অ্যাম্বাসিতে আবেদনের সংখ্যা ১০ শতাংশ বেড়েছে। যেটা এর আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
গণমাধ্যম ও এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসরায়েলিদের অভিবাসন একটি ব্যাপক আলোচ্য বিষয়। ইসরায়েলে গুগল সার্চে সবচেয়ে বেশিবার সার্চ করা বিষয়ের ভেতর রয়েছে মুভিং আউট বা বেরিয়ে যাওয়া। বর্তমানে ফেসবুকে একটি জনপ্রিয় গ্রুপও রয়েছে। এই গ্রুপের নাম লিভিং দ্য কান্ট্রি-টুগেদার (একসঙ্গে দেশ ছাড়ি)। এখানে দেশ ছাড়তে ইসরায়েলিরা ভিসা ও পাসপোর্টবিষয়ক বিভিন্ন আলোচনা করেন।
২০২২ সালে ইসরায়েলে নির্বাচনের পর থেকে ইসরায়েলিদের ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে নাগরিকত্বের আবেদনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর যে কোনো একটির পাসপোর্ট জোটাতে পারলেই অন্তর্ভুক্ত সব দেশেই থাকা, পড়ালেখা এবং কাজ করার সুযোগ পাবে ইসরায়েলিরা। বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের জাতীয়তা পেতে ইসরায়েলিদের আগ্রহ বাড়লেও এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র মুখ খুলতে নারাজ। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের জন্য আবেদনকারী ইসরায়েলির সংখ্যা বেড়েছে নাকি কমেছে তা নিয়েও কোনো তথ্য দেবে না দেশটি।
সম্প্রতি ইসরায়েলে যে দ্বন্দ্বময় পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে তাতে হাজারো ইসরায়েলি নতুন একটি দেশে যাওয়ার পাঁয়তারা খুঁজছেন। তারা এখন কোন দেশে সহজে পাসপোর্ট মিলবে, কোন দেশের পাসপোর্ট পেতে কম টাকা খরচ হবে এবং কোন কোন দেশ পাসপোর্ট পাওয়ার পদ্ধতি সহজ করেছে তা খুঁজছে।
ইসরায়েলিরা মনে করেন, ইউরোপিয়ান জাতীয়তা তাদের জন্য সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলে দেবে। ইসরায়েলি ভ্রমণবিষয়ক কোম্পানিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসরায়েলিদের প্রলুব্ধ করতে নানা বিজ্ঞাপনও দিচ্ছে। ইউরোপিয়ান পাসপোর্টের প্রতি আগ্রহের আরেকটি কারণ হলো এতে করে ২৮টি দেশে ইচ্ছামতো ভ্রমণ ও থাকার সুযোগ পাওয়া যাবে।
ইসরায়েলিদের এই দেশগুলোতে যেতে চাওয়ার মূল কারণ নিরাপত্তা। এখানে বলা বাহুল্য, শুধু যুদ্ধাবস্থার কারণেই তারা নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে চান বিষয়টি এমন নয়। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে জীবনযাত্রার মান, শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ, বিনামূল্যের শিক্ষা প্রভৃতি কারণগুলোও। অনেক ইসরায়েলি এমনটাও মনে করেন, দেশটিতে জীবনযাত্রার মানও চরম অবস্থায় পৌঁছেছে।
চলমান সময়ে নাগরিকত্বের আবেদনের সংখ্যায় ব্যাপক বৃদ্ধির বিষয়টি ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, রোমানিয়া, পর্তুগাল, স্পেন, জার্মান ও ইটালি স্বীকার করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসরায়েলিরা দেশ থেকে অন্য দেশে চিরস্থায়ী বসবাসের বিষয়টিকে 'পালানোর পরিকল্পনা' বলছেন। বর্তমানে যা ঘটছে তা নিয়ে ভয়ের ভেতর রয়েছে ইসরায়েলিরা।
রাফায়েল ডিফেন্স সিস্টেমের সাবেক পরিচালক জিওরা সালজ বেফাঁস এক মন্তব্যে বলেছেন, আমি আর আমার নাতি নাতনিরা আর ইসরায়েলে থাকতে আগ্রহী নই। কিছুদিন আগ পর্যন্তও ইসরায়েল থেকে অন্য দেশে চিরতরে চলে যাওয়ার বিষয়টিকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে বিবেচিত হতো। তবে এখন আর সেদিন নেই। অনেক ইসরায়েলিই আরেকটি পাসপোর্ট থাকার বিষয়টিকে অনেকটা ইনস্যুরেন্সের মতো করে দেখছেন।
ইসরায়েল ছাড়ার বিষয়টি রীতিমতো আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। লিভিং দ্য কান্ট্রি-টুগেদার নামের গ্রুপটি ১০ হাজার ইসরায়েলিকে দেশ ছাড়ার বিষয়ে সাহায্য করছে। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্দোলকারী নেতা ইয়ানিভ গোরিক এবং ব্যবসায়ী মোরদেচাই কাহানে যেসব ইসরায়েলি দেশ ছেড়ে আমেরিকা যেতে চান তাদের সাহায্য করার ঘোষণা দিয়েছেন। বর্তমান সরকারের নেওয়া বিভিন্ন বিতর্কিত পদক্ষেপের জন্য যদি ইসরায়েলের অবস্থা আরও খারাপ হয় তাহলে ইহুদিবাদী আন্দোলনকে পথ দেখাতেই এসব পথ খোলা রাখছেন তারা। অনেক ইহুদিরাই মনে করেন, ইসরায়েলে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এদিকে ইসরায়েল রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আনার চেষ্টারত। ২০২০ সাল নাগাদ ৭ লাখ ৫৬ হাজার ইসরায়েলি দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন। এই হিসাবে অন্য দেশে জন্ম নেওয়া শিশুদের সংখ্যা বিবেচনায় আনা হয়নি। পুনরায় ইসরায়েলিদের সংখ্যা কমে যাওয়ার পুরোনো ভয় জেগে উঠছে বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
মন্তব্য করুন