ইসরায়েলের চারপাশ ঘিরে থাকা মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে দীর্ঘদিনের বৈরী সম্পর্ক থাকলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আঞ্চলিক স্বার্থ, রাজনৈতিক চুক্তি ও অর্থনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে সম্পর্কের রূপ পাল্টেছে।
একদিকে ফিলিস্তিনে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরে যখন মানবিক বিপর্যয় চলছে, তখন কিছু আরব দেশ ইসরায়েলকে সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে বিভিন্নভাবে সহায়তা করছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে—এই সহযোগিতা কীভাবে ইসরায়েলকে আরও আগ্রাসী করে তুলছে?
শুরুতে ২০২০ সালে আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। চুক্তির পর, দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ২০২৪ সালের মধ্যে এই বাণিজ্যের পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
বিশেষ করে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা সংস্থা ইসরায়েলি সামরিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘থার্ডআই সিস্টেমসে’ ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে, যা ইসরায়েলের অস্ত্রশিল্পকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
মিসর ও জর্ডান, যারা পূর্বেই ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করেছে, তারাও অর্থনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ থেকেছে। মিসর ২০২৪ সালে ইসরায়েলে প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি ১২% বাড়িয়েছে। আর জর্ডান কৃষি ও পানি সম্পদের বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
সৌদি আরব এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি না দিলেও, ইরানের হুমকির মুখে ইসরায়েলের সঙ্গে গোপন গোয়েন্দা সহযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদন জানায়। ২০২৪ সালে ইরান থেকে ইসরায়েলের দিকে ছোড়া ড্রোন প্রতিহত করতে সৌদি ও জর্ডানের আকাশসীমা ব্যবহার করেছিল ইসরায়েলি ও মার্কিন সামরিক বিমান। এটি ইসরায়েলকে প্রতিরক্ষায় সুবিধা দিয়েছে।
এছাড়া, বাহরাইন ও মরক্কো আব্রাহাম চুক্তিতে যুক্ত হয়ে ইসরায়েলের কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করেছে। এভাবে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেকে আরও বৈধতা দিতে পেরেছে।
মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আরব দেশগুলোতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ও অস্ত্র সরবরাহের অন্যতম উৎস হতে পারে। সৌদি আরবের প্রিন্স সুলতান এয়ার বেস ও কাতারের আল উদেইদ ঘাঁটি থেকে ইসরায়েলে অস্ত্র পরিবহন ও সরঞ্জাম জোগানের অভিযোগ উঠেছে।
তুরস্ক, যদিও ফিলিস্তিনের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে, তথাপি গাজায় হামলার সময়েও ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে গেছে। কিছু প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, তুরস্কের বন্দর থেকে ইসরায়েলে পণ্য এবং সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ হয়েছে।
ইরানবিরোধী অবস্থানই ইসরায়েল-আরব ঘনিষ্ঠতার মূল চালিকা শক্তি। সৌদি আরব, আমিরাত এবং বাহরাইনের মতো দেশগুলো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতায় আগ্রহী।
জর্ডান ও মিসরের মতো দেশগুলো সংঘাত এড়িয়ে নিজেদের অর্থনীতি ও নিরাপত্তা অগ্রাধিকার দিচ্ছে, যা পরোক্ষভাবে ইসরায়েলের অবস্থানকে শক্তিশালী করছে।
ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশের এসব সহযোগিতা সরাসরি জনসমর্থন পাচ্ছে না। বরং আরব জনগণের বড় একটি অংশ ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করছে। সরকারগুলো তাই নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় এসব সম্পর্ক গোপন রাখে বা প্রতীকী প্রতিবাদে সীমাবদ্ধ রাখে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দ্বিমুখী নীতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। একদিকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি, অন্যদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থ—এই দ্বন্দ্ব আরব বিশ্বের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
ইসরায়েলের চারপাশে মুসলিম দেশগুলো থাকার পরও, আঞ্চলিক রাজনীতি ও কৌশলগত সমীকরণে সেই দেশগুলোর ভূমিকাই এখন তেল আবিবকে আরও সাহসী করে তুলেছে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে যে সহযোগিতা ইসরায়েল পাচ্ছে, তা শুধু ফিলিস্তিন নয়, পুরো মুসলিম বিশ্বে প্রতিবাদের ধাক্কা তৈরি করছে।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন থেকে যায়—ইসরায়েলকে শক্তিশালী করে কে বা কারা দাঁড়াচ্ছে মানবতার বিপরীতে?
মন্তব্য করুন