সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে দুই দিনের ব্যবধানে আলাওয়াইত সম্প্রদায়ের ১০০ জনেরও বেশি সদস্যকে অপহরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অপহৃতদের মধ্যে নারী, পুরুষ ও কিশোর-কিশোরীরা রয়েছেন। এই ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দেশটির সংখ্যালঘু এই সম্প্রদায়ের মধ্যে।
সোমবার (২৪ মার্চ) ইরানের আধা সরকারি সংবাদ সংস্থা মেহের নিউজের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরিয়ার কেন্দ্রীয় প্রদেশ হোমস ও হামা, পাশাপাশি উপকূলীয় লাতাকিয়া ও টারটাস অঞ্চলে অপহরণের এই প্রবণতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
স্থানীয় গণমাধ্যম আল-মায়াদিন ও অন্যান্য সূত্রের বরাতে জানা গেছে, অপহরণকারীরা সাধারণত সন্ধ্যার পর বা ভোরের দিকে পথচারীদের টার্গেট করছে। বিভিন্ন সড়ক, গ্রাম ও উপকূলীয় শহরগুলোর বাজার থেকে মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, অস্ত্রধারী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এই অপহরণে জড়িত। তারা সামরিক পোশাক পরে, কখনও সরকারি বাহিনীর পরিচয়ে এসে, আবার কখনও অজ্ঞাতপরিচয় মুখোশধারী হিসেবে অপহরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, আলাওয়াইত সম্প্রদায় মূলত সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুসারী। সিরিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই সম্প্রদায় বহু বছর ধরে বিভিন্ন বিদ্রোহী ও উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তু হয়ে আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশটিতে শাসন পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত সহিংসতা চালানো হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্র বলছে, বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও উগ্রপন্থি মিলিশিয়ারা সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে তাদের বসতি থেকে উচ্ছেদ করতে চাইছে। বিশেষ করে, সিরিয়ার উপকূলীয় এলাকাগুলোতে যেখানে আলাওয়াইত ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের আধিক্য বেশি, সেখানে পরিকল্পিতভাবে অপহরণ, হত্যা ও হামলা বাড়ছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সিরিয়ার প্রায় প্রতিটি প্রদেশ থেকেই প্রতিদিন গড়ে ২০ জন আলাওয়াইত সম্প্রদায়ের সদস্যকে অপহরণ করা হচ্ছে। অনেকের কোনো সন্ধান মিলছে না, কেউ কেউ আবার মুক্তিপণের বিনিময়ে ছাড়া পেলেও তাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী লাতাকিয়া শহর থেকে আল-মায়াদিন টিভিকে বলেন, গত কয়েক সপ্তাহে আমাদের শহরে অন্তত ৫০ জন নিখোঁজ হয়েছে। তারা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বা বাজারে কেনাকাটা করতে গিয়ে অপহৃত হয়েছে। কোনো ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তোলার সুযোগই পাচ্ছি না।
সিরিয়ায় যুদ্ধ চলাকালীন উপকূলীয় অঞ্চলগুলো তুলনামূলক নিরাপদ ছিল। তবে সম্প্রতি এই এলাকাগুলোতেও সহিংসতা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে লাতাকিয়া, টারটাস, হোমস ও হামা প্রদেশ এখন আর নিরাপদ নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক রিদওয়ান আহমেদ বলেন, এই অপহরণ এবং সহিংসতার মূল উদ্দেশ্য হলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভীত করে রাখা। এটি কেবল বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার অংশ নয়, বরং সিরিয়ায় রাজনৈতিক ও সামরিক পরিবর্তনের একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল।
এদিকে সিরীয় সরকার এখন পর্যন্ত এই অপহরণের বিরুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেয়নি। তবে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কয়েকটি তদন্ত শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
অপরদিকে বাশার আল-আসাদপন্থি গোষ্ঠীগুলো এই অপহরণের জন্য বিদ্রোহী বাহিনী ও ইসলামপন্থি গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করেছে। অন্যদিকে, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো দাবি করছে, এটি সিরীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে চালানো প্রতিশোধমূলক হামলার অংশ।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি এই অপহরণ ও সহিংসতার ঘটনা অব্যাহত থাকে, তাহলে সিরিয়ায় নতুন করে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে, আলাওয়াইত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত নিপীড়ন দেশটিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করবে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো সিরিয়ায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এই প্রবণতা বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তবে বাস্তবে সংঘাত ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চলতে থাকলে এই সংকট আরও গভীর হতে পারে।
মন্তব্য করুন