দীর্ঘ ১৫ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার গোষ্ঠী হামাস যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। এই যুদ্ধবিরতি ৩টি ধাপে বাস্তবায়নের কথা ছিল।
প্রথম ধাপে ৪২ দিনের জন্য সংঘর্ষ বন্ধ রাখা হয়, দ্বিতীয় ধাপে গাজায় সব ধরনের সামরিক কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘটানো এবং তৃতীয় ধাপে ইসরায়েলি সেনাদের স্থায়ীভাবে প্রত্যাহার করা হবে বলে চুক্তি হয়।
তবে যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার আগেই ইসরায়েল তাদের সামরিক তৎপরতা বাড়িয়ে তোলে। সর্বশেষ গত সোমবার (১৮ মার্চ) ইসরায়েলি সেনারা যুদ্ধবিরতির চুক্তি ভেঙে গাজার ওপর ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে, যেখানে এক রাতের মধ্যেই ৪০০-রও বেশি মানুষ নিহত হয়।
এই হামলার ফলে প্রায় দুই মাস ধরে চলা যুদ্ধবিরতি পুরোপুরি ভেস্তে যায়। নতুন করে শুরু হওয়া হামলায় এখন পর্যন্ত ৬০০-রও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। খবর আল জাজিরা।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, যুদ্ধবিরতির সময়টাকে ইসরায়েল কৌশলগতভাবে ব্যবহার করেছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকাকালে গাজায় ব্যাপক নজরদারি চালিয়েছে দখলদার দেশটি। মূলত হামাসের আস্তানা, তাদের সামরিক স্থাপনা ও জিম্মিদের সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
লন্ডনের কিংস কলেজের নিরাপত্তা শিক্ষা বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক আন্দ্রেস ক্রেইগ বলেন, আমি মনে করি, ইসরায়েল এই যুদ্ধবিরতির সুযোগ নিয়ে হামাসকে আরও দুর্বল করার কৌশল নিয়েছে। তারা হামাস নেতাদের অবস্থান চিহ্নিত করেছে এবং তাদের হত্যার চেষ্টা চালাচ্ছে, যেমনটি আমরা সম্প্রতি কোনো সতর্কতা প্রদান না করে যে হামলা করেছে ইসরায়েল।
তিনি আরও বলেন, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির সময় হামাসের সামরিক শক্তি পর্যালোচনা করেছে, বিভিন্ন ঘাঁটির অবস্থান শনাক্ত করেছে এবং সম্ভবত তাদের হাতে আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের অবস্থান সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করেছে। এখন তারা হামাসের নেতাদের টার্গেট করে হামলা চালাচ্ছে।
এদিকে গত সোমবারের ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজার ডি ফ্যাক্টো প্রধানমন্ত্রীসহ হামাসের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ নেতা নিহত হন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির সুযোগ নিয়ে হামাসের নেতৃত্বকে দুর্বল করার পরিকল্পনা করেছিল এবং এখন সেটি বাস্তবায়ন করছে।
এর আগে যুদ্ধবিরতির সময়ই ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আমান এবং শিন বেত গাজার ভেতরে একাধিক অভিযান পরিচালনা করেছিল। এসব অভিযানের মাধ্যমে তারা হামাসের বিভিন্ন স্থাপনা, ভূগর্ভস্থ টানেল এবং কমান্ড সেন্টারগুলোর অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পায়।
আল জাজিরা বলছে, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) এই যুদ্ধবিরতিকে একটি ‘কৌশলগত বিরতি’ হিসেবে নিয়েছিল এবং এটি ব্যবহার করে ভবিষ্যতের সামরিক পরিকল্পনা সাজিয়েছে।
অধ্যাপক আন্দ্রেস ক্রেইগ আরও বলেন, ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য গাজার কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চল দখল করা, যা তারা আর কখনোই ছাড়বে না। বিশেষ করে উত্তর গাজা এবং কিছু কৌশলগত এলাকা তারা স্থায়ীভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনা করছে।
তিনি বলেন, ইসরায়েল গাজার সাধারণ মানুষকে সীমিত একটি এলাকায় আবদ্ধ করে রাখতে চাইছে, যাতে তারা ভবিষ্যতে আরও সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে পারে। পাশাপাশি তারা হামাসের শক্তি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে চায়।
বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধবিরতির নামে ইসরায়েল মূলত গাজায় সামরিক কৌশল বাস্তবায়ন করেছে এবং এই সংঘাতের অবসান শিগগিরই হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। বরং তারা ধাপে ধাপে গাজায় নিজেদের উপস্থিতি আরও জোরদার করছে, যা ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যতের জন্য আরও কঠিন পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়।
মন্তব্য করুন