ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় রমজান মাসের শুরুতেই তীব্র দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে সাধারণ মানুষ। ইসরায়েলি হামলার ধ্বংসস্তূপের মাঝে ঠাঁই নেওয়া গাজার লাখো মুসলমান সেহরি ও ইফতার আয়োজন করতে গিয়ে সীমাহীন সংকটে পড়েছেন। খাদ্যসংকট, বিশুদ্ধ পানির অভাব, নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব, বৈরী আবহাওয়া এবং অবরুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে তাদের জন্য রমজান মাসের প্রতিটি মুহূর্তই চরম কষ্টের হয়ে উঠেছে।
শনিবার (১ মার্চ) বার্তাসংস্থা আনাদুলু এজেন্সির এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
বৃষ্টিতে ভিজে সেহরি, ক্ষুধার্ত দিনের শুরু
শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) গাজায় শুরু হয় পবিত্র রমজান। বিশ্বজুড়ে মুসলিমরা রোজার প্রথম দিন সেহরির মাধ্যমে শুরু করলেও গাজার ফিলিস্তিনিদের জন্য এই রাত ছিল দুঃসহ। ভারী বৃষ্টিতে তাদের অস্থায়ী তাঁবুগুলো প্লাবিত হয়ে যায়। অনেকেই ঘুম থেকে উঠে দেখেন, তাঁবুর ভেতর পানি জমে গেছে, খাবার ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ভিজে গেছে। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে তাঁবু ছেড়ে খোলা জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। কিন্তু প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে সেটিও ছিল কঠিন।
যারা ধ্বংসস্তূপে ফিরে গেছেন, তারাও দুর্ভোগের মধ্যে ছিলেন। ফাঁকা দেয়াল ও ছাদের ফাটল দিয়ে পানি প্রবেশ করায় অনেকের ঘুমানোর সুযোগও হয়নি। ফলে সেহরির সময় তারা তেমন কিছুই খেতে পারেননি। কেউ শুকনো রুটি বা খেজুর দিয়ে সেহরি করেছেন, আবার কেউ পানি পান করেই রোজা শুরু করেছেন।
ইফতারে খাবারের সংকট, ত্রাণ সহায়তাও অপ্রতুল
দিনভর রোজা রাখার পর গাজার মুসলিমরা যখন ইফতারের অপেক্ষায় ছিলেন, তখনও তাদের কপালে জুটেছে চরম দুর্ভোগ। ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজায় খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফলে পর্যাপ্ত ইফতার সামগ্রী জোগাড় করা অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয়নি।
যারা কিছুটা খাদ্য পেয়েছেন, তারা সাধারণত শুকনো রুটি, খেজুর এবং সামান্য পানি দিয়ে ইফতার করেছেন। রান্না করার মতো পর্যাপ্ত গ্যাস ও বিদ্যুৎ না থাকায় অনেকেই কোনো গরম খাবার তৈরি করতে পারেননি। কিছু পরিবার মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভর করলেও ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণের কারণে গাজায় প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রবেশ করতে পারছে না, যার ফলে সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।
গাজার বাসিন্দা মুহাম্মদ আল-মাসরি আনাদোলু এজেন্সিকে বলেন, ‘রমজান আমাদের জন্য আনন্দের সময় হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবতা আমাদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে তুলেছে। আমরা ইফতারের জন্য পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছি না, আমাদের শিশুদের জন্য দুধ নেই, আমরা কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি।’
যুদ্ধবিরতি, কিন্তু সংকট এখনো অব্যাহত
গত ১৯ জানুয়ারি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, যার আওতায় গাজায় ত্রাণ ও পুনর্নির্মাণ সামগ্রী প্রবেশের কথা ছিল। কিন্তু দখলদার ইসরায়েল সে চুক্তি বাস্তবায়ন না করায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি এখনো তাঁবুতে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার ৮৮ শতাংশ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে, যার মধ্যে হাসপাতাল, বাজার, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত।
আন্তর্জাতিক সহায়তার আকুতি
গাজার স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং ইসলামিক সংস্থাগুলো ফিলিস্তিনিদের জন্য আরও বেশি সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছে। গাজার পৌরসভার মুখপাত্র হোসনি মাহনা বলেন, ইসরায়েল অবিলম্বে ত্রাণ সহায়তা প্রবেশের অনুমতি না দিলে আগামী দিনগুলো আরও ভয়াবহ হতে পারে।
গাজার মানুষের লড়াই অব্যাহত
দীর্ঘ দখলদারিত্ব, হামলা ও অবরোধের মধ্যেও গাজার মানুষ তাদের আত্মমর্যাদা রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। রমজানের প্রথম দিন চরম দুর্ভোগের মধ্যে কাটলেও তারা ধৈর্য ও সংযমের সঙ্গে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন।
তবে সংকট সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন। ইসরায়েলের অবরোধ অব্যাহত থাকলে গাজার মানুষদের জন্য রমজানের দিনগুলো আরও কঠিন হয়ে উঠবে, যা মানবিক বিপর্যয়কে চরম পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
মন্তব্য করুন