মধ্যপ্রাচ্যের দুটি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ, ইরান ও ইসরায়েল। যুগ যুগ ধরে একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং নতুন অস্ত্র প্রযুক্তির উন্মোচন ইসরায়েলের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। ফলে একে অপরকে ‘জমদূত’ হিসেবে দেখার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ইরান নিয়মিত বড় পরিসরে সামরিক মহড়া পরিচালনা করছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে— কেন ইরান ইসরায়েলের জন্য ‘যমদূত’ হয়ে উঠছে?
ইরানের সামরিক শক্তির বিস্তার
ইরান বর্তমানে বিশ্বের ১৪তম বৃহত্তম সামরিক শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে। দেশটি সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি অত্যাধুনিক ড্রোন এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি ইরান তাদের ‘গাজা’ ড্রোন উন্মোচন করেছে। এটি একসঙ্গে ১২টি বোমা বহন করতে সক্ষম এবং ৪ হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এই শক্তিশালী ড্রোন ইসরায়েলের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ এটি দেশটির সীমান্তের বাইরেও হামলা চালাতে সক্ষম।
এ ছাড়া ইরান তাদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পে বিপুল অগ্রগতি করেছে। ‘ইতেমাদ’ নামের নতুন ক্ষেপণাস্ত্রটি ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দূর থেকে আঘাত হানতে সক্ষম, যা ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা
ইরান ও ইসরায়েল বহু বছর ধরে শত্রু দেশ হিসেবে পরিচিত। ইরান ইসরায়েলের অস্তিত্বকে বরাবরই চ্যালেঞ্জ করে আসছে। ইসরায়েলও ইরানকে তার প্রধান শত্রু হিসেবে দেখে। ইরানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি নিয়ে ইসরায়েল উদ্বিগ্ন। ইরান যদি তার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ও আক্রমণাত্মক ড্রোন প্রযুক্তি দিয়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে তোলে, তবে তা ইসরায়েলের জন্য বড় বিপদ সৃষ্টি করবে। যেহেতু ইরান পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে, কাজেই এ শক্তি মোকাবিলায় ইসরায়েল নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
ইরানের সামরিক কৌশল
ইরান সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য একের পর এক নতুন মডেলের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন তৈরি করছে। সম্প্রতি, ইরান রাশিয়ার তৈরি সুখোই-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার মাধ্যমে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করেছে। পাশাপাশি, ইরান ভূগর্ভস্থ ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি উন্মোচন করেছে। এসব নতুন অস্ত্র ইসরায়েলের জন্য নতুন ধরনের হুমকি সৃষ্টি করছে। কারণ ইসরায়েলকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন অস্ত্রের মোকাবিলা করতে হবে।
পারমাণবিক পরিকল্পনা
ইরান দীর্ঘদিন ধরে পরমাণু শক্তির অধিকারী হওয়ার জন্য কাজ করছে। যদিও তাদের দাবি, পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। তবে পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র, ইরানের পরমাণু কার্যক্রমকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। প্রতিক্রিয়ায় ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য
ইরান মূলত দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও অত্যাধুনিক ড্রোন যুক্ত করে যুদ্ধক্ষেত্রে শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি করতে চায়। শত্রু রাষ্ট্রগুলোকে মোকাবিলা ও নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা এ পদক্ষেপ নিচ্ছে। এতে এটি স্পষ্ট, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দুই দেশের মধ্যে নতুন সংঘর্ষের সম্ভাবনা রয়েছে।
সামরিক বাজেট ও বাহিনী
২০২৩ সালে ইরান সামরিক বাজেট বাড়িয়ে ৯৯৫ কোটি ডলার করেছে। সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ ৮০ হাজার। তাদের বিমানবাহিনীতে ৫৫১টি বিমান রয়েছে, যার মধ্যে ১৮৬টি যুদ্ধবিমান, ২৩টি অ্যাটাকিং বিমান ও ১২৯টি হেলিকপ্টার রয়েছে।
ইরানের ভূরাজনৈতিক প্রভাব
বর্তমানে ইরানের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিস্তার করছে। বিশেষ করে সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন ও লেবাননে। তারা এসব দেশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। এটিই ইসরায়েল ও পশ্চিমা বিশ্বের জন্য অস্বস্তির কারণ। এমনকি ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার করেছে ইরান।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর পাশাপাশি ইরানের বিরুদ্ধে যে কোনো সামরিক হুমকি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, ইসরায়েল এ রকম হুমকির বিরুদ্ধে পরমাণু অস্ত্রও ব্যবহার করতে পারে। পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তায় ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালানোর পরিকল্পনাও রয়েছে দেশটির। তবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র কোনো ধরনের হামলা চালালে এ অঞ্চলে ‘সর্বাত্মক যুদ্ধ’ শুরু হবে বলে কড়া সতর্ক করেছে ইরান।
তথ্য: আল জাজিরা, তেহরান টাইমস, পার্স টুডে, দ্য গার্ডিয়ান ও মেহের নিউজ এজেন্সি
মন্তব্য করুন