দীর্ঘ ১৫ মাস ধরে চলা সংঘাতের পর অবশেষে গাজায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে হামাস ও ইসরায়েল। ইসরায়েলের মন্ত্রিসভাও যুদ্ধবিরতির চুক্তি অনুমোদন দিয়েছে। প্রায় ৪৭ হাজার ফিলিস্তিনির প্রাণ এবং লক্ষাধিক মানুষ আহত হওয়ার বিনিময়ে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের অবসান হতে যাচ্ছে।
আজ রোববার (১৯ জানুয়ারি) থেকে এ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে।
কাতারের মধ্যস্থতায় হওয়া এ চুক্তির আওতায় গাজায় সংঘাত বন্ধের পাশাপাশি উপত্যকাটিতে হামাসের হাতে বন্দি ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির পথও খুলতে যাচ্ছে। যদিও গাজার সংকট সমাধান এখনো সুদূর রেখা, তবু দীর্ঘ কয়েক মাস আলোচনার ফল এ চুক্তিকে গাজা যুদ্ধ বন্ধের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এর আগেও কাতার ও মিসরে গাজার যুদ্ধবিরতি নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে। ইসরায়েল ও হামসের প্রতিনিধিরা সেসব আলোচনা অংশ নিয়েছেন। তবে কোনো না কোনো পক্ষের অসহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত সেসব প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখেনি। তবে দুপক্ষই এবার এ চুক্তি মেনে নেওয়ার কথা জানিয়েছে। আর এখানে কাজ করেছে কয়েকটি দেশের জোর প্রচেষ্টা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নেতানিয়াহুর ওপর চাপ বাড়ছিল, যা যুদ্ধবিরতিকে ত্বরান্বিত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি এর জন্য নিজের কৃতিত্ব দাবি করেছেন। কীভাবে এ যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হবে, তাও তুলে ধরেন তিনি। হামাস ও ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হওয়ার পর হোয়াইট হাউসে এক ভাষণে বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে বিস্তারিত তথ্য জানিয়েছেন।
বাইডেন বলেন, তিন ধাপে এ যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হবে। প্রথম ধাপ ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হবে। দ্বিতীয় ধাপে যুদ্ধের স্থায়ী সমাপ্তি নিয়ে আলোচনা চলছে এবং তৃতীয় ধাপে হবে গাজার পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহের একটি প্রাথমিক যুদ্ধবিরতির সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময়ে গাজা উপত্যকা থেকে ধীরে ধীরে ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে এবং হামাসের হাতে আটক বন্দিদের মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলের কারাগারে থাকা ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে।
চুক্তি অনুযায়ী, প্রথম ধাপে ৩৩ জন ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেবে হামাস, যাদের মধ্যে সব নারী, শিশু ও ৫০ বছরের বেশি বয়সী পুরুষ রয়েছেন। এ সময় রাফাহ সীমান্ত দিয়ে গাজায় প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক ত্রাণ ও চিকিৎসাসামগ্রী প্রবেশ করতে দেওয়া হবে। গাজায় অবশিষ্ট হাসপাতালগুলোকে সচল রাখতে ৫০টি জ্বালানি ভর্তি লরিও পাঠানো হবে।
গাজার জনবহুল এলাকা থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে গাজার সীমান্তের ৭০০ মিটারের (২ হাজার ২৯৭ ফুট) বেশি দূরে অবস্থিত এলাকায় ইসরায়েল তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করবে। ইসরায়েল বেসামরিক নাগরিকদের গাজার উত্তরে তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে দেবে।
ইসরায়েল আহত ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসার জন্য গাজা ত্যাগের অনুমতি দেবে এবং প্রথম ধাপ বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার সাত দিন পর মিসরের সঙ্গে রাফাহ ক্রসিং খুলে দেবে। ইসরায়েলি বাহিনী মিসর ও গাজার সীমান্তবর্তী ফিলাডেলফি করিডোরে তাদের উপস্থিতি হ্রাস করবে এবং চুক্তি কার্যকর হওয়ার ৫০তম দিনের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করবে।
চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে শর্ত পূরণ হলে ইসরায়েলের কারাগারে বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্তির বিনিময়ে অবশিষ্ট সব জীবিত জিম্মিদের মুক্তি ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের বিষয় রয়েছে।
তৃতীয় ধাপে অবশিষ্ট মৃতদেহগুলোর ফেরত দেওয়া এবং গাজা পুনর্গঠনের কাজ শুরুর কথা রয়েছে। এই কাজ পরিচালিত হবে মিসর, কাতার ও জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে। এ ছাড়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য মিসরের রাজধানী কায়রোতে একটি যৌথ কার্যক্রম কক্ষ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে কাতার, যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েলের প্রতিনিধিরা থাকবেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে সশস্ত্র ব্যক্তিরা ইসরায়েলের সীমান্ত এলাকায় হামলা চালিয়ে ১ হাজার ২০০ জন সেনা ও বেসামরিক মানুষ হত্যা এবং ২৫০ জনকে বন্দি করে। এর পর থেকেই গাজায় ব্যাপক সামরিক হামলা শুরু করে ইসরায়েল। তবে ১৫ মাস ধরে ইসরায়েলের টানা হামলা অপরাধী-নিরপরাধ বিচার করেনি। ৪৬ হাজারেরও বেশি নিরীহ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে তারা। বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ২৩ লাখ মানুষ। এই নির্মমতা বন্ধে পৃথিবীব্যাপী জনমত সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।
তবে যুদ্ধবিরতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করে ইসরায়েলে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভায়ও ক্ষোভ দেখা গেছে। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী বেন গাভির যুদ্ধবিরতি ইস্যুতে পদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন। তবে যুদ্ধবিরতির পক্ষেও ইসরায়েলে মিছিল হয়েছে। ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি নির্বিশেষে মানুষ চাইছে শান্তি।
মন্তব্য করুন