বাশার আল আসাদকে হটিয়ে সিরিয়ার রাষ্ট্র ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিদ্রোহীরা। দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের পতন ঘটানোর পেছনে নেতৃত্বের ভূমিকায় আছে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নামের একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী। এই এইচটিএসের নেতা আবু মোহাম্মেদ আল-জোলানি। যাকে জীবিত বা মৃত হাতে পেতে একসময় পুরস্কার ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের সফলতা এবং পরবর্তী প্রেক্ষাপটে এইচটিএস ও জোলানির নাম আলোচনায়। দেশটির শাসনক্ষমতা এখন অনেকটা জোলানির নিয়ন্ত্রণে। এমন পরিস্থিতিতে জোলানির মাথার জন্য ১ কোটি ডলারের ঘোষণা বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
দীর্ঘদিন ধরে জোলানিকে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে তার মাথার জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া তার দল এইচটিএস-কে ২০১৮ সালে নিষিদ্ধ সংগঠনের তালিকাভুক্ত করে মার্কিন প্রশাসন।
শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) দামেস্কে সিরিয়ার নতুন শাসকদের সঙ্গে প্রথম সরাসরি বৈঠক করেন মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তারা। দলটিতে ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের শীর্ষ কর্মকর্তা বার্বারা লিফ, প্রেসিডেন্টের হোস্টেজ বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি রজার কারস্টেনস এবং জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ড্যানিয়েল রুবিনস্টাইন।
এ বিষয়ে বার্বারা বলেন, তাহরির আল শামের প্রধান আহমেদ আল শারার সঙ্গে তাদের আলোচনা ভালো হয়েছে। দেশটির কোনো গোষ্ঠী যেন সিরিয়া ও বহির্বিশ্বের জন্য হুমকি না হয়ে উঠতে পারে এ বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আল শারার মাথার জন্য ১ কোটি ডলারের যে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র সেটি তুলে নেওয়া হয়েছে।
এইচটিএসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আল-জোলানি প্রায় এক দশক ধরে নিজেকে অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী থেকে আলাদা করার চেষ্টা করেছেন এবং তাদের বৈশ্বিক কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে সিরিয়ায় একটি ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র’ গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেছেন।
২০১৬ সাল থেকে তিনি এবং তার গোষ্ঠী নিজেদের সিরিয়ার স্বাধীন অঞ্চলের বিশ্বস্ত রক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় একটি জনপ্রিয় বিদ্রোহকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করেন, যার পরিণতি হিসেবে যুদ্ধ চলতে থাকে। এইচটিএস ২০১৭ সালে সিরীয় স্যালভেশন গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠা করে, যা ইদলিব প্রদেশে প্রশাসন পরিচালনা করে। এ সরকার স্থানীয় সেবা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিচারব্যবস্থা ও অবকাঠামো সরবরাহের পাশাপাশি অর্থনীতি এবং সাহায্য বিতরণও নিয়ন্ত্রণ করে। তবে এইচটিএস তার শাসনকে কঠোরভাবে পরিচালনা করে এবং বিরোধিতা সহ্য করে না বলে জানান গোষ্ঠীর সক্রিয় কর্মীরা। বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদন থেকেও এ তথ্য পাওয়া যায়। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠান সিরিয়া ডাইরেক্ট জানায়, রাজনৈতিক কর্মীদের গুম করার পেছনে এইচটিএসের হাত রয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো জনতার ওপর গুলি চালিয়েছে এ গোষ্ঠী। অভিযোগ রয়েছে, এ গোষ্ঠী তাদের বিরোধী সম্প্রদায়গুলোকে বিভিন্ন সেবা সরবরাহ থেকে বঞ্চিত করেছে।
আল-জোলানি ১৯৮২ সালে সৌদি আরবের রিয়াদে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তার নাম ছিল আহমদ হুসেন আল-শারার। তার বাবা রিয়াদে পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৮৯ সালে তার পরিবার সিরিয়ায় ফিরে আসে এবং দামেস্কের কাছাকাছি বসবাস শুরু করে।
২০০৩ সালে তিনি ইরাক চলে যান এবং আল কায়েদা (ইরাক) সদস্য হিসেবে যুক্ত হন। সংগঠনটি ওই বছরের আমেরিকার আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২০০৬ সালে তাকে ইরাকে আমেরিকান বাহিনী আটক করে এবং পাঁচ বছর বন্দি রেখে পরবর্তীকালে সিরিয়ায় আল কায়েদার শাখা আল-নুসরা ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার কাজ দেয়। এ গোষ্ঠী সিরিয়ার বিরোধী অঞ্চলে বিশেষত ইদলিবে প্রভাব বিস্তার করে। আল-জোলানি প্রথমদিকে আবু বকর আল-বাগদাদির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, যিনি আল কায়েদার ‘ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক’-এর প্রধান ছিলেন। এটি পরে আইএসআইএল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে আল-বাগদাদি হঠাৎ করে ঘোষণা দেন, তার গোষ্ঠী আল কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এবং সিরিয়ায় বিস্তার লাভ করবে। ফলে আল-নুসরা ফ্রন্টকে আইএসআইএসে একীভূত করে নেওয়া হয়। আল-জোলানি এ পরিবর্তন প্রত্যাখ্যান করেন এবং আল কায়েদার প্রতি তার আনুগত্য বজায় রাখেন। ২০১৪ সালে তার প্রথম টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে আল-জোলানি আলজাজিরাকে বলেন, সিরিয়াকে তার গোষ্ঠীর ‘ইসলামিক আইন’ অনুযায়ী শাসন করা উচিত এবং দেশটির সংখ্যালঘু গোষ্ঠী যেমন, খ্রিষ্টান এবং আলাওয়িরা সেখানে স্থান পাবে না। পরবর্তী বছরগুলোতে আল-জোলানি আল কায়েদার বৈশ্বিক খিলাফত প্রতিষ্ঠার প্রকল্প থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। তখন সিরিয়ার ভেতরে নিজেদের শক্তিশালী করাই তার গোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য হিসেবে বলে মনে হতে থাকে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে আসাদ সরকারের কাছে আলেপ্পোর পতন হলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ইদলিবে চলে যেতে শুরু করে। তখন আল-জোলানি ঘোষণা দেন, তার গোষ্ঠীর নাম পরিবর্তন করে ‘জাবহাত ফাতেহ আল-শাম’ রাখা হয়েছে। ২০১৭ সালের শুরুতে, হাজার হাজার যোদ্ধা আলেপ্পো থেকে পালিয়ে ইদলিবে প্রবেশ করার পর আল-জোলানি তার গোষ্ঠীকে আরও কয়েকটি গোষ্ঠীর সঙ্গে একীভূত করে এইচটিএস গঠন করেন। এইচটিএসের প্রধান লক্ষ্য, সিরিয়াকে স্বৈরশাসক সরকার থেকে মুক্ত করা, ইরানি মিলিশিয়াদের দেশ থেকে বের করে দেওয়া এবং ইসলামিক আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
মন্তব্য করুন