সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কর্মরত হাজারো সিঙ্গেল মাদার এখন চরম সংকটে পড়েছেন। এসব নারীদের অভিযোগ, তাদের সন্তানদের জন্ম সনদ দেওয়া হচ্ছে না, যার ফলে তারা সৌদি আরব থেকে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারছেন না।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করা বেশিরভাগ নারীর সন্তান বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক থেকে জন্ম নিয়েছে, আর সেই কারণে তাদের শিশুরা সৌদি আরবে জন্ম সনদ পায়নি। এসব শিশুদের নিবন্ধন না হওয়ার ফলে তারা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিশুরা স্কুলে ভর্তি হতে পারছে না, স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না এবং সবচেয়ে বড় কথা, তাদের মা-ও দেশে ফেরার জন্য প্রয়োজনীয় ভিসা পাচ্ছেন না।
প্রসঙ্গত, সৌদি আরবের ইসলামিক আইন অনুযায়ী, বিয়েবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। এই কারণে, এসব নারী শুধু যে সামাজিকভাবে অবহেলিত হচ্ছেন, তা নয়, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। অনেক নারীই অভিযোগ করেছেন, তারা নির্যাতনকারী নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছেন, যারা তাদের পরিচয়পত্রও আটকে রেখেছেন।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, সৌদিতে ধর্ষণ বা যৌন পাচারের শিকার নারীরাও বিয়েবহির্ভূত যৌন সম্পর্কের অভিযোগে অভিযুক্ত হন। এই নারীদের জন্য বিচারও কঠিন হতে পারে, কারণ তাদের গর্ভধারণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
এমন পরিস্থিতিতে, সৌদি আরবে কর্মরত এসব গৃহকর্মী মায়েরা তাদের সন্তানদের জন্য স্কুলে ভর্তি করার চেষ্টা করলেও, জন্ম নিবন্ধন না হওয়ায় তা সম্ভব হচ্ছে না। তার ওপর, সৌদি সরকার থেকে কোনো সহায়তা না পাওয়ার কারণে, এসব মা-রা নিজ দেশে ফেরার জন্য প্রয়োজনীয় ভিসা পাচ্ছেন না। তাদের সন্তানদের ‘রাষ্ট্র পরিচয়হীন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, ফলে তারা কোনো ধরনের সরকারি সেবা বা সহায়তা পেতে পারছে না।
এই নারীদের মধ্যে অনেকেই নির্যাতনের শিকার। তারা জানায়, তাদের নিয়োগকর্তা তাদের শারীরিক এবং যৌন নির্যাতন করেছেন। একজন নারী ফাতিমা (ছদ্মনাম) জানাচ্ছেন যে, তিনি তার নিয়োগকর্তার বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেন, কারণ তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছিল এবং তার পাসপোর্টও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে, তাকে অনানুষ্ঠানিকভাবে কাজ করতে হচ্ছে।
ফাতিমা আরও জানান, তিনি একসময় হাসপাতালে প্রসব বেদনা নিয়ে ছুটে গেলেও, প্রয়োজনীয় নথিপত্র না থাকায় তাকে গ্রেপ্তারের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তিনি আতঙ্কিত হয়ে বাড়ি ফিরে যান এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যে একা একা সন্তান জন্ম দেন।
ফাতিমা এবং তার মতো আরও নারীরা সৌদি আরব ছাড়ার জন্য বহু চেষ্টা করেছেন। তারা সৌদি আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিবাদ সমাবেশও করেছেন, তবে সৌদি আরবে যেকোনো ধরনের প্রতিবাদ অবৈধ এবং এর জন্য কঠোর শাস্তি হতে পারে। তারা স্লোগান দিয়ে নিজেদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা এবং মৌলিক অধিকার দাবি করেছেন, তবে তাদের কথা শুনে কেউ এগিয়ে আসেনি।
এছাড়া, এসব সিঙ্গেল মাদাররা যখন তাদের দেশে ফেরার জন্য সহায়তা চেয়েছেন, তখন তারা পেয়েছেন অস্বীকৃতি। কেনিয়ার দূতাবাস জানিয়েছে, তারা ‘অস্বীকৃত’ সন্তানদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া শুরু করবে না, কারণ এসব শিশুর জন্মের কোনো বৈধতা নেই। এক নারী ক্রিস্টিন তিনি জানান, কেনিয়ার দূতাবাসের কর্মীরা তাদের যৌনকর্মী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যদিও তাদের অনেকেই নির্যাতনের শিকার।
অভিবাসী অধিকারবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি আরব এবং অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলোতে বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক থেকে জন্ম নেয়া শিশুদের সংখ্যা হাজার হাজার হতে পারে। তারা বলেন, জন্মের পরিস্থিতি যাই হোক, প্রতিটি শিশুরই নিজস্ব পরিচয় এবং মৌলিক অধিকার রয়েছে, যা তাদের দেওয়া উচিত।
এভাবে, এসব সিঙ্গেল মাদাররা সৌদি আরব ছাড়ার অপেক্ষায় রয়েছেন, তবে নানা আইনি জটিলতা এবং মানবিক সংকটের কারণে তারা কিছুই করতে পারছেন না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মুদি দোকান থেকে ভিক্ষা করে সন্তানদের খাবার দেন। অনেকেই তাদের সন্তানদের ভালোভাবে বড় করার জন্য সংগ্রাম করছেন, কিন্তু তাদের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা বিপুল।
এদিকে সৌদি সরকার এবং স্থানীয় দূতাবাস যদি তাদের সমস্যার সমাধান না করে, তবে এসব নারীদের ভবিষ্যত আরও অন্ধকার হতে পারে।
মন্তব্য করুন