সিরিয়ার দামেস্ক শহরের মুস্তাহিদ হাসপাতালের দেয়ালে ঝুলে থাকা মৃতদেহের ছবি গুলি দেখলে মনে হয়, যেন এক কঠিন যন্ত্রণায় হারিয়ে গেছে কতিপয় নিরপরাধ মানুষের জীবন। মৃতদেহগুলোর মুখাবয়ব ছিল বিকৃত, ভয়াবহ ও যন্ত্রণাকাতর।
এই মৃতদেহগুলো হাসপাতালের ভেতরে রাখা হয়েছে। দামেস্কের বাইরে অন্য একটি হাসপাতাল থেকে আনা এই মৃতদেহগুলো ছিল কারাবন্দিদের। তাদের মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক বেদনার ইতিহাস, আর তাদের পরিবারদের কাছে এই মৃতদেহগুলো খোঁজার প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে এক হৃদয়বিদারক যুদ্ধ।
একেকটি মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে, স্বজনরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। তারা আশা করছেন, যদি তাদের প্রিয়জনের মৃতদেহ খুঁজে পেয়ে সেটি অন্তত দাফন করতে পারেন। কেউ কেউ মৃতদেহের ছবির কাছে গিয়ে পরিচিত মুখ খুঁজে পেতে মোবাইল ফোনে ছবি বা ভিডিও করেন, যেন পরে পরিবারে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে নিশ্চিত হতে পারেন। তাদের একমাত্র কামনা, তাদের হারানো প্রিয়জনদের শেষ দেখতে পাওয়া।
অথচ মৃতদেহগুলোর অধিকাংশ এমন এক অবস্থায় ছিল, শরীরের পচন ধরেছিল। এর মধ্যে কিছু মৃতদেহ সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা ছিল, কারণ মৃতদেহগুলো এত দ্রুত পচে গিয়েছিল যে সেগুলোর চেহারা চেনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তবে কয়েকটি মৃতদেহে কোনো বিশেষ চিহ্ন ছিল—যেমন ট্যাটু, দাগ বা ক্ষত—যেগুলোর মাধ্যমে পরিচিতদের শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল।
মুস্তাহিদ হাসপাতালের মর্গে মোট ৩৫টি মৃতদেহ রাখা হয়েছে, তবে মর্গের ধারণক্ষমতার বাইরে অতিরিক্ত একটি রুমে মৃতদেহগুলো বডিব্যাগে ভরে রাখা হয়েছে। মৃতদেহগুলো একে একে মর্গে এসে পৌঁছেছে, কিন্তু সেগুলোর অবস্থা এত বেশি খারাপ, অনেক সময় স্বজনরা তাদের পরিচিতদের খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় নাভিশ্বাস তুলে ফেলেন।
ফরেনসিক দন্তচিকিৎসক ডা. রাঘদ আত্তার, যিনি মৃতদেহ শনাক্ত করার জন্য দাঁতের রেকর্ড পরীক্ষা করছেন, তার চোখে বিরাজ করছে এক গভীর দুঃখ ও কষ্ট। তিনি বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক, যে আমরা সবসময় শুনে আসি বন্দিরা দীর্ঘ সময় ধরে নিখোঁজ থাকে। কিন্তু যখন এটা নিজে দেখতে হয়, তখন এটা সহ্য করা খুব কঠিন হয়ে ওঠে। তিনি নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, আমি সত্যিই এই পরিবারগুলোর জন্য খুব দুঃখিত।
একজন বোন যার নাম নূর। তার ভাইকে ২০১২ সালে সিরিয়ার সাইদনা কারাগার থেকে তুলে নেওয়ার পর থেকে কোনো খোঁজ পাননি। তার ভাইকে সেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল এবং তারা এক ফেসবুক পোস্ট থেকে জানতে পারেন, সেখানে বন্দিদের মরতে ছেড়ে দেওয়া হয়।
নূর বলছিলেন, আমরা শুধু চাই, যদি তার মৃতদেহটা খুঁজে পাই, তাহলে অন্তত জানব সে কোথায়, কীভাবে মারা গেছে। আমরা তার জন্য শান্তি চাই।
এটি শুধু সিরিয়ার বাস্তবতা নয়, এটি এমন এক গভীর শোকের চিত্র, যেখানে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেছে, তাদের প্রিয়জনরা তাদের মরদেহ পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছে না। সিরিয়ার জনগণ দীর্ঘ দশক ধরে যন্ত্রণার মধ্যে বসবাস করছে এবং এখন সেই শোষণের চিত্র ফুটে উঠেছে একে একে মৃতদেহের মধ্যে।
সিরিয়ার ইতিহাসে এই নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, নিখোঁজ হওয়ার কষ্ট শুধু শাসক পরিবারটির নির্মম শাসনেরই পরিচায়ক নয়, বরং এটি গোটা সিরিয়ার জন্য এক অবর্ণনীয় শোকের দাগ হয়ে থাকবে।
আসাদ পরিবারের শাসনকাল আসলে এক ভয়াবহ বাস্তবতার নাম, যেখানে জনগণের জীবন কোনো মূল্যই পায়নি। এর প্রতিটি স্তর থেকে বেরিয়ে এসেছে এক অসম্ভব দুঃখ, যেখানে মানবাধিকারের কোনো মানদণ্ড নেই এবং প্রতিটি পরিবার তাদের প্রিয়জনের মরদেহ খুঁজে বেড়াচ্ছে, যেন অন্তত তাদের শান্তির জন্য একটি শেষ ব্যবস্থা করতে পারে।
মন্তব্য করুন