লেবাননের রাজধানী বৈরুতে মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) সন্ধ্যায় বিমান হামলা করে ইসরায়েল। সেদিকে যখন মধ্যপ্রাচ্য নজর রাখছিল ঠিক তখন আকস্মিক এক খবর আসে। বুধবার (৩১ জুলাই) সকালে জানা যায়, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়াহকে হত্যা করা হয়েছে। আর সেটি ঘটেছে ইরানের রাজধানী তেহরানে।
ঘটনাটি যেন স্তম্ভিত করে দিয়েছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে। চারপাশে আলোচনা চলছে, এবার কী হবে? চলমান গাজা যুদ্ধ ঘিরে নতুন কী ভয়াবহতা সামনে অপেক্ষা করছে?
ইতোমধ্যে আলজাজিরা এক বিশ্লেষণে জানিয়েছে, পরবর্তীতে কী ঘটতে পারে তা অনুমান করা বেশ কঠিন। এর ফলে আরও গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে এবং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজা উপত্যকাজুড়ে যুদ্ধের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।
অন্যদিকে এও শোনা যাচ্ছে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবার হামাস ধ্বংসের কথা বলছিলেন। তিনি গোষ্ঠীটির শীর্ষ নেতৃত্ব বিনাশ করার ওপর জোর দিচ্ছিলেন। সুতরাং তাদের প্রধান নেতাকে খুন করতে পারাই হতে পারে নেতানিয়াহুর কাঙ্ক্ষিত নিরঙ্কুশ বিজয়।
ইসমাইল হানিয়াহ ইসরায়েলিদের মধ্যেও একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী যদি একজন প্রভাবশালী হামাস নেতাকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় তবে এটি এই যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারে। সে হিসেবে হানিয়াহর হত্যাকাণ্ড যুদ্ধের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য অর্জন করে এবং হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বকে নির্মূল করার যে অঙ্গীকার তা বাস্তবায়ন হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। ইসরায়েলি জনগণও যদি তা ভাবতে থাকে তবে তারা যুদ্ধ বন্ধে নেতানিয়াহুর ওপর আরও চাপ বাড়াবে পারে। কারণ, সাধারণ জনগণ তাদের জিম্মি স্বজনদের গাজা থেকে জীবিত ফেরত চায়। ফিলিস্তিনিদের ধ্বংসের চেয়ে বন্দি স্বজনদের জীবন তাদের কাছে প্রিয়।
অপরদিকে কঠিন প্রতিশোধের কবলে ইসরায়েলের পড়ার বিষয়েও বিশ্লেষণ চলছে। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস গুপ্তহত্যার প্রতিবাদে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। তিনি হানিয়াহর হত্যাকে কাপুরুষোচিত আচরণ বলে উল্লেখ করেন। শোক প্রকাশ করে আব্বাস সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধৈর্য ও দৃঢ়তার সঙ্গে ইসরায়েলি আগ্রাসন মোকাবিলার আহ্বান জানান।
তবে পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি ঘোলাটে হবে ইরান যদি সামরিক জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কয়েক মাস আগেই ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা দেখেছে বিশ্ব। যা মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করেও শেষমেশ ক্ষান্ত হয়।
আলজাজিরার বিশ্লেষণ বলছে, সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলার জবাবে ৩০০-এর বেশি ড্রোন-মিসাইল ছোড়ে তেহরান। ইসরায়েলে সরাসরি এটিই প্রথম ইরানের হামলা। জবাবে ইসরায়েলও হামলা চালায়। তখন পুরো বিশ্ব এ প্রতিক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ে। এবারও ইরান তার মাটিতে গুপ্তহত্যার বিচার চাইতে পারে। বর্তমানে সব অভিযোগ যেহেতু ইসরায়েলের দিকে সেহেতু নেতানিয়াহুর দিকেই বন্দুক তাক করতে পারে ইরান। তবে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা এখনই বলা কঠিন। পুরো মধ্যপ্রাচ্য ইরানের প্রতিক্রিয়ার দিকে চেয়ে আছে। তেহরানের ঘোষণার সঙ্গে যোগ দিতে প্রস্তুত হয়ে আছে হিজবুল্লাহ ও হুতিরা ।
এদিকে হানিয়াহকে হত্যার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। তারা এ হত্যার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে বিবৃতিও দেয়নি।
উল্লেখ্য, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়াহকে হত্যা করা হয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের বরাতে আলজাজিরা বুধবার (৩১ জুলাই) এ খবর জানায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসমাইল হানিয়াহ গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) একটি বিবৃতি উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হানিয়াহ মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) থেকে তেহরানে অবস্থান করছিলেন। হামাস নেতারা যে ভবনে অবস্থান করছিলেন সেখান থেকে বুধবার (৩১ জুলাই) সকালে হানিয়াহ এবং তার একজন দেহরক্ষীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে। বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
বিষয়টি এক বিবৃতিতে হামাসও নিশ্চিত করেছে। তারা বলছে, আমাদের ভাই, নেতা, মুজাহিদ, স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান ইসমাইল হানিয়াহর তেহরানের বাসভবনে বিশ্বাসঘাতক জায়নবাদীরা হামলা করেছে। তিনি শহীদ হয়েছেন। ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ফিলিস্তিনি জনগণ, আরব ও ইসলামি জাতি এবং বিশ্বের সব স্বাধীন মানুষের কাছে শোকের দাবি করে।
গাজা উপত্যকায় হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন ইসমাইল হানিয়া। ২০০৪ সালে ইসরায়েলি বিমান হামলায় শেখ আহমেদ ইয়াসিন নিহত হন। এরপর উপত্যকায় ইসমাইল হানিয়ার প্রভাব বাড়তে থাকে। এ নেতার সরাসরি রাজনীতিতে উত্থান ঘটে ২০০৬ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের আগে। তখন মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন বিভক্ত ফাতাহ দলকে হারিয়ে চমক দেখায় হামাস। ওই নির্বাচনে সাংগঠনিক পারদর্শিতায় কর্মীদের মন জয় করেন তিনি। এর ফলশ্রুতিতে ইসমাইল হানিয়া ২০১৭ সাল থেকে হামাসের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার জনপ্রিয়তায় তিনি বারবার গোষ্ঠীটির নেতা নির্বাচিত হন।
মন্তব্য করুন