দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ইতিহাস মূলত বিরোধ, যুদ্ধ এবং অবিশ্বাসের গল্প। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাজনের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভাবের পর থেকেই এই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ও সংঘাত একাধিকবার চরমে পৌঁছেছে। কাশ্মীর সমস্যা থেকে শুরু করে ধর্মীয় বিভাজন, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি নানা ইস্যু এই দ্বন্দ্বকে আরও জটিল করে তুলেছে।
প্রধান বিরোধের কারণসমূহ: ১. কাশ্মীর সংকট ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর কাশ্মীরের অধিভুক্তি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। তৎকালীন মহারাজা হরি সিং কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করেন, যা পাকিস্তানের জন্য ছিল অগ্রহণযোগ্য। এর ফলেই ১৯৪৭-৪৮ সালে প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। কাশ্মীর আজও উভয় দেশের জাতীয় গর্ব ও রাজনৈতিক স্বার্থের প্রতীকে পরিণত হয়েছে, এবং এ অঞ্চল ঘিরেই বারবার সংঘাত ছড়িয়েছে।
২. ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন ভারত ও পাকিস্তান—দুটি রাষ্ট্রই গড়ে উঠেছিল আলাদা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে। পাকিস্তান নিজেকে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই ভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বৈরিতাকে আরও গভীর করেছে।
৩. সন্ত্রাসবাদ ও নিরাপত্তা ইস্যু ভারত দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাসবাদে সহায়তার অভিযোগ করে আসছে, বিশেষ করে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে। অন্যদিকে, পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে। এই পারস্পরিক অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
৪. পানি বণ্টন সংকট সিন্ধু নদী ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের পানি বিরোধ রয়েছে। যদিও ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানি চুক্তি কিছুটা শান্তি এনেছিল, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নদী ব্যবস্থাপনা ও নতুন প্রকল্প নিয়ে উত্তেজনা পুনরায় বাড়ছে।
৫. পারমাণবিক প্রতিযোগিতা ১৯৭৪ সালে ভারতের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষার পর ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানও পারমাণবিক শক্তি অর্জনের ঘোষণা দেয়। উভয় দেশের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন এবং তা ঘিরে প্রতিযোগিতা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তাকে নাজুক করে তুলেছে।
কালপঞ্জি:
১৯৪৭
১৪ ও ১৫ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা।
কাশ্মীরের দখল নিয়ে প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সূচনা।
১৯৪৯
জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি; লাইন অব কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৬৫
কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বিতীয় পাক-ভারত যুদ্ধ।
তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান।
১৯৭১
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ।
পাকিস্তানের পূর্বাংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ।
১৯৯৮
উভয় দেশের পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা; দক্ষিণ এশিয়ায় পরমাণু উত্তেজনা বৃদ্ধি।
১৯৯৯
কারগিল যুদ্ধ; পাকিস্তানি সেনা ও জঙ্গিরা লাইন অব কন্ট্রোল অতিক্রম করে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করে।
ভারত সেনা অভিযান চালিয়ে দখলমুক্ত করে।
২০০১
ভারতের সংসদ ভবনে হামলা; দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধপরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
২০০৮
মুম্বাইতে ধারাবাহিক জঙ্গি হামলা; ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জঙ্গি মদদের অভিযোগ তোলে।
২০১৬
উরি সেনাঘাঁটিতে হামলার পর ভারত ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালানোর দাবি করে।
২০১৯
পুলওয়ামা হামলায় ৪০ জন ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য নিহত হন।
পাল্টা ভারতীয় বিমান হামলা; বালাকোটে কথিত জঙ্গি ঘাঁটি লক্ষ্য করে আঘাত।
একই বছরে ভারত সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা তুলে দেয়; পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মহলে কাশ্মির ইস্যু উত্থাপন করে।
উভয় দেশের মধ্যে ট্র্যাক-টু কূটনীতি ও জনগণ-জনগণ যোগাযোগ সীমিত হয়ে পড়ে।
২০২৫
২২ এপ্রিল: জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার পহেলগামে বৈসরান উপত্যকায় সশস্ত্র ব্যক্তিদের একটি দল পর্যটকদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এই হামলায় অন্তত ২৮ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে পর্যটক ও সরকারি কর্মচারী—উভয়ই ছিলেন। আরও কয়েকজন আহত হন।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এই ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে অভিহিত করে এবং ভারতবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকেই দায়ী করে। একাধিক গণমাধ্যম দাবি করেছে যে, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লশকর-ই-তৈয়বার সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট এই হামলার দায় স্বীকার করে।
তবে পাকিস্তান সরকার এ দাবিকে অস্বীকার করেছে এবং কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে যে দায় স্বীকারের বিষয়টি স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি।
ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো হামলায় জড়িত তিন সন্দেহভাজনের স্কেচ প্রকাশ করেছে। গোয়েন্দা সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে ‘পিটিআই’ জানিয়েছে, হামলাকারীদের সবাই লস্কর-ই-তৈয়বার সঙ্গে যুক্ত এবং তাদের মধ্যে কমপক্ষে দু’জন ‘বিদেশি’ বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের বিরোধ মূলত আস্থা সংকট ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। কাশ্মীর প্রশ্নের ন্যায়সঙ্গত ও শান্তিপূর্ণ সমাধান ছাড়া স্থায়ী শান্তি অর্জন প্রায় অসম্ভব বলেও তারা মনে করেন।
পাশাপাশি দুই দেশের জাতীয়তাবাদী রাজনীতি প্রায়শই সম্পর্ক উন্নয়নের পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে। ভবিষ্যতে পারস্পরিক স্বার্থে উভয় পক্ষের মধ্যে আস্থা পুনর্গঠনের উদ্যোগই বিরোধ নিরসনের একমাত্র পথ হতে পারে।
পহেলগাম হামলা আবারও প্রমাণ করেছে, কাশ্মীর ইস্যুতে স্থায়ী সমাধান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি সুদূরপরাহত। উভয় দেশের উচিত পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে এই দীর্ঘদিনের বিরোধের অবসান ঘটানো।
মন্তব্য করুন