জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। প্রতিবেশী দেশ দুটির পাল্টাপাল্টি অবস্থান নতুন করে যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছে। আর এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যেই আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর (আইএএফ) যুদ্ধ সক্ষমতা। পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা দ্য নিউজ রোববার প্রকাশিত এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে এ বিষয়টি তুলে ধরেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তান-ভারত সংঘর্ষের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আর সেসব সংঘর্ষে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সক্ষমতা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরে পাকিস্তান কর্তৃক ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি মিগ-২১ ভূপাতিত করা এবং পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে আটক করা, ভারতীয় বিমানবাহিনী আবারও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।
ভারতীয় সরকারি মিডিয়ার প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় বিমানবাহিনী মোট ২,৩৭৪টি বিমান দুর্ঘটনায় হারিয়েছে। এর মধ্যে ১,১২৬টি ছিল ফাইটার জেট এবং ১,২৪৮টি ছিল অন্যান্য শ্রেণির বিমান। এ ছাড়াও ২২৯টি প্রশিক্ষণ বিমান এবং ১৯৬টি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার ফলে ১,৩০৫ জন দক্ষ পাইলটের করুণ মৃত্যু হয়েছে।
এই বিপুল ক্ষতির পরিসংখ্যান ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলোকে স্পষ্ট করে তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে বিমানবাহিনীর আধুনিকীকরণে গাফিলতি এবং পুরোনো প্রযুক্তিনির্ভরতা এর প্রধান কারণ। তারা বলছেন, এছাড়াও আইএএফের কমব্যাট এয়ারক্রাফটের ঘাটতি ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার একটি গুরুতর দুর্বলতা।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ইতিহাসের একাধিক যুদ্ধে আইএএফ উল্লেখযোগ্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ১৯৪৭-৪৮, ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালের বড় যুদ্ধে এবং ১৯৯৯ সালের কারগিল সংঘাতে ভারতীয় বিমানবাহিনী বিমানের পাশাপাশি অভিজ্ঞ পাইলটও হারিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএএফর মোট ক্ষতির তুলনায় যুদ্ধক্ষেত্রের ক্ষয়ক্ষতির হার কম- মাত্র ১৪৩টি বিমান যুদ্ধক্ষেত্রে হারিয়েছে, যা মোট ক্ষতির প্রায় এক-অষ্টমাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশেষ করে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় পাকিস্তান বিমানবাহিনীর (পিএএফ) প্রাথমিক হামলায় ভারতীয় বিমানবাহিনীর ৫৯টি বিমান ঘাঁটিতেই ধ্বংস হয়, যা ভারতীয় গোয়েন্দা এবং প্রস্তুতির ব্যর্থতার একটি বড় উদাহরণ। আইএএফ নিজেও তাদের সরকারি রিপোর্টে স্বীকার করেছে, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে তারা পিএএফের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ১৯৬০-এর দশক থেকে শুরু করে ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রধান দুর্বলতা ছিল বিমানের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ঘাটতি। বিশেষ করে মিগ-২১ যুদ্ধবিমান, যা ১৯৬০-এর দশকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘উড়ন্ত কফিন’ এবং ‘বিধবা প্রস্তুতকারী’ নামে পরিচিতি পায়।
২০০২ সালের ভারতীয় সংসদের পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির একটি অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ১৯৯১-৯৭ সালের মধ্যে প্রতি ১০,০০০ ঘণ্টা ফ্লাইটে দুর্ঘটনার হার ছিল ০.৮৯ থেকে ১.৫২; যেখানে শুধু ফাইটার জেটের ক্ষেত্রে এই হার ছিল ১.৮৯ থেকে ৩.৫৩ পর্যন্ত। মিগ-২১ ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে এটি আরও ভয়াবহ ছিল- ২.২৯ থেকে ৩.৯৯ পর্যন্ত।
আইএএফের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে উঠে এসেছে যে, মানবীয় ভুল, প্রযুক্তিগত ত্রুটি এবং প্রাকৃতিক কারণ (যেমন খারাপ আবহাওয়া ও পাখির আঘাত) দুর্ঘটনার মূল কারণ। বিশেষ করে মিগ-২১ বিমানগুলোর প্রযুক্তিগত দুর্বলতা এবং প্রশিক্ষণের ঘাটতি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
১৯৮০ ও ১৯৯০ দশকে প্রশিক্ষক বিমানের দুর্ঘটনার হার ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিশেষ করে এইচপিটিই-৩২ প্রশিক্ষক বিমান বহু দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল, যা শেষ পর্যন্ত ১৯ জন পাইলটের প্রাণহানির পর ২৩ বছরের ব্যবহারে স্থগিত করা হয়। এছাড়াও, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ সুবিধার দুর্বল অবকাঠামো এবং অত্যাধুনিক প্রশিক্ষক বিমানের অভাবে বহু তরুণ পাইলট ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে।
দ্য নিউজে প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে পাহালগাম হামলার পর ভারতের মধ্যে যুদ্ধোন্মাদনা বাড়ছে। কিন্তু ভারতীয় বিমান বাহিনীর অতীত রেকর্ড এবং বর্তমান ফ্লিটের অবস্থা তাদের যুদ্ধ সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তারা কি আসলেই বড় ধরনের সংঘাতে কার্যকরভাবে লড়তে সক্ষম?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুদ্ধবাজ ভাষণ ও শক্তি প্রদর্শনের আগে ভারতের উচিত হবে তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ভেতরের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা এবং আধুনিকীকরণে মনোনিবেশ করা।
মন্তব্য করুন