ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত।
সুপ্রিম কোর্টে এ আইনকে কেন্দ্র করে দায়ের হওয়া ৭৩টি পিটিশনের শুনানিতে উঠে আসে ধর্মীয় ভারসাম্য, সাংবিধানিক অধিকার ও সম্পত্তির মালিকানা ঘিরে নানা বিতর্ক।
স্থানীয় সময় বুধবার (১৬ এপ্রিল) প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চে শুনানির সময় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে স্পষ্ট প্রশ্ন রাখা হয়, হিন্দু এনডাওমেন্ট (মন্দির বা দেবোত্তর সম্পত্তির পরিচালনা করে যারা) বোর্ডে কি কোনো মুসলিম সদস্য রাখা হয়? যদি না রাখা হয়, তাহলে ওয়াকফ বোর্ডে হিন্দু সদস্য কেন থাকবে? খবর এনডিটিভি।
প্রধান বিচারপতির এই প্রশ্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে তীব্র আলোড়ন তোলে। তিনি আরও বলেন, ওয়াকফ আইন নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতা হচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এসময় আদালত ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ এবং কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলে অমুসলিম সদস্য নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়েও কেন্দ্রের কাছে ব্যাখ্যা চায়।
উল্লেখ্য, ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ হল এমন একটি ধারণা, যেখানে কোনও জমি দীর্ঘদিন ধরে মসজিদ, কবরস্থান, মাদ্রাসা কিংবা অন্য ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হলে, কাগজপত্র ছাড়াও সেই জমিকে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা যায়। তবে নতুন সংশোধনী আইনে বলা হয়েছে, কেবল কাগজপত্র থাকা জমিতেই এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে। এই পরিবর্তন নিয়ে চলছে বিতর্ক।
এদিকে পিটিশনকারীদের পক্ষে বিশিষ্ট আইনজীবী কপিল সিবাল বলেন, ওয়াকফ ইসলামের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক অংশ। অনেক পুরোনো ওয়াকফ সম্পত্তির কোনও দলিলপত্র নেই, তা সত্ত্বেও এগুলো ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন সেই জমির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, যা সংবিধানের ২৬ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করছে।
তিনি আরও বলেন, ওয়াকফ বোর্ডে জেলা প্রশাসককে রাখা হয়েছে, যিনি সরকারের অংশ। সরকারের প্রতিনিধি এই বোর্ডে থাকলে তার সিদ্ধান্ত পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে।
আরেক আইনজীবী অভিষেক মনু সিংভি জানান, ভারতের প্রায় ৮ লাখ ওয়াকফ সম্পত্তির মধ্যে ৪ লাখই ‘ওয়াক্ফ বাই ইউজার’। এসব জমির কাগজপত্র পাওয়া দুষ্কর। নতুন আইনে বলা হচ্ছে, কাগজপত্র না থাকলে সেসব সম্পত্তি রাষ্ট্রের দখলে চলে যাবে—যা ইতিহাস ও বাস্তবতা অস্বীকার করে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা শুনেছি, দিল্লি হাইকোর্ট নিজেও ওয়াকফ জমির ওপর নির্মিত। তার মানে এইসব ব্যবহারভিত্তিক ওয়াকফ জমি মিথ্যা নয়। কাগজপত্র না থাকলেও ঐতিহাসিক বাস্তবতা উপেক্ষা করা যায় না। তিনি আরও বলেন, ১৩, ১৪ কিংবা ১৫ শতকে নির্মিত মসজিদের দলিল পাওয়া স্বাভাবিক নয়।
সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে এই সংবেদনশীল আইন সংক্রান্ত প্রশ্নগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে বলেছে। বিশেষ করে ধর্মীয় বোর্ডে প্রতিনিধিত্ব ও মালিকানার নীতিমালাকে আরও স্বচ্ছ ও সাংবিধানিকভাবে গ্রহণযোগ্য করার উপর গুরুত্বারোপ করেছে আদালত।
প্রসঙ্গত, এই শুনানি কেবল ওয়াকফ আইনের বৈধতা নয়, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ও সংবিধানিক ভারসাম্য নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছে। পরবর্তী শুনানিতে এই বিষয়ে চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ দিতে পারে আদালত।
মন্তব্য করুন