ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আবারও ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার দায় অস্বীকার করেছেন আন্তর্জাতিক এক সাক্ষাৎকারে।
প্রধানমন্ত্রী মোদি দাবি করেছেন, তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তার মতে, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো তাকে কালিমালিপ্ত করতে দীর্ঘদিন ধরে গুজরাট দাঙ্গার প্রসঙ্গ টেনে এনেছে।
রোববার (১৬ মার্চ) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি-তে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকার থেকে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের টানা তিন বারের প্রধানমন্ত্রী মোদি যুক্তরাষ্ট্রের পডকাস্ট হোস্ট লেক্স ফ্রিডম্যানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মোদি বলেন, ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা শুধু আমাকে বদনাম করার জন্য। এর কোনো ভিত্তি নেই।
প্রসঙ্গত, ২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গুজরাটের গোধরা শহরে সবরমতী এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এতে ৫৯ জন হিন্দু তীর্থযাত্রী নিহত হন। নিহতদের বেশিরভাগ ছিলেন অযোধ্যা থেকে ফেরত আসা করসেবক, যারা বাবরি মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এই ঘটনার পর গুজরাটের বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে, যা ভারতীয় ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ দাঙ্গা হিসেবে পরিচিত। সরকারি হিসেবে, দাঙ্গায় প্রায় ১,০৪৪ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে ৭৯০ জন মুসলিম এবং ২৫৪ জন হিন্দু ছিলেন। তবে বেসরকারি সূত্রগুলো বলছে, এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। দাঙ্গায় হাজার হাজার বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়া হয়, হাজারেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হন, এবং লাখেরও বেশি মানুষ ঘরছাড়া হন।
সেসময় গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। দাঙ্গার সময় তার প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি এবং মুসলিমদের ওপর হামলার বিষয়ে নীরব থেকেছে বলে অভিযোগ ওঠে। মোদিকে দোষারোপ করা হয়, কারণ দাঙ্গা চলাকালীন পুলিশের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ এবং মোদির সরকার তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেয়নি বলে সমালোচনা হয়।
কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়, দাঙ্গা চলাকালে মোদি প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি, গুজরাট পুলিশের এক সিনিয়র কর্মকর্তা সঞ্জীব ভাট দাবি করেন, মুখ্যমন্ত্রী মোদি নাকি পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন দাঙ্গাকারীদের কাজে বাধা না দিতে। যদিও মোদি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
সাক্ষাৎকারে মোদি বলেন, ২০০২ সালের দাঙ্গা নিয়ে একটা প্রচার চালানো হয়েছে যেন এটি গুজরাটের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দাঙ্গা ছিল। কিন্তু সত্য হলো, অতীতেও অনেক দাঙ্গা হয়েছে, তবে শুধু গুজরাটের ঘটনাকেই বারবার সামনে আনা হয়।
তিনি আরও বলেন, কিছু রাজনৈতিক দল এবং বিদেশি মিডিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে আমার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছে। ছোটখাটো ঘটনাকেও বড় করে দেখানো হয়েছে। যেমন, ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা বা সাইকেলে ধাক্কা লাগার মতো ছোট ঘটনায়ও বলা হয়েছে—‘দাঙ্গা হয়েছে’।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ‘ইন্ডিয়া : দ্য মোদি কোয়েশ্চেন’ শিরোনামে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করে। এতে দাবি করা হয়, গুজরাট দাঙ্গার ঘটনায় মোদি পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছিলেন এবং এই দাঙ্গার কারণে তার জনপ্রিয়তা বাড়ে, যা তাকে পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে সাহায্য করে।
তথ্যচিত্রে বলা হয়, ব্রিটিশ সরকারের এক গোপন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, গুজরাট দাঙ্গা ছিল ‘পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা’, যেখানে মুসলিমদের ওপর ‘সুনির্দিষ্টভাবে আক্রমণ’ করা হয়েছিল।
অপরদিকে নরেন্দ্র মোদির বর্তমান সরকার এই তথ্যচিত্রকে ‘প্রোপাগান্ডা’ বলে অভিহিত করে এবং ভারতে এর সম্প্রচার নিষিদ্ধ করে দেয়।
এদিকে দাঙ্গার ঘটনার পর মোদির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়, তবে ২০১২ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ তদন্ত দল (এসআইটি) মোদিকে ক্লিন শিট দেয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, মোদির বিরুদ্ধে কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি যা দেখাতে পারে যে তিনি দাঙ্গা ছড়ানোর জন্য দায়ী ছিলেন।
এরপর, ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্ট আরও একবার মোদিকে নির্দোষ ঘোষণা করে এবং বলে যে, মোদির বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ছিল।
মোদি আরও দাবি করেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। আমার সরকার বরাবরই আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিল। আমি সব ধর্মের মানুষকে সমান চোখে দেখি এবং আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
স্বাধীনতার পর ভারতের সবচেয়ে বড় গুজরাট দাঙ্গার পর মোদির ভাবমূর্তি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়— হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কাছে নায়ক : অনেক হিন্দু জাতীয়তাবাদী মোদিকে একজন শক্তিশালী নেতা হিসেবে দেখে, যিনি হিন্দু স্বার্থ রক্ষা করেন। অপরদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিতর্কিত ব্যক্তি : ভারত ও আন্তর্জাতিক মহলে অনেকেই তাকে মুসলিমবিরোধী নেতা হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।
তবে দাঙ্গার পরও মোদির রাজনৈতিক ক্যারিয়ার অব্যাহত থাকে। তিনি তিনবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর, ২০১৯ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয়বার জয়ী হন। সর্বশেষ ২০২৪ সালে তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন।
২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার ঘটনা আজও ভারতীয় রাজনীতিতে অন্যতম বিতর্কিত বিষয়। যদিও ভারতের আদালত মোদিকে নির্দোষ ঘোষণা করেছে, তবে বিরোধীরা তাকে এখনো দায়ী করে এবং আন্তর্জাতিক মহলেও এই ইস্যুতে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। মোদি অবশ্য সবসময়ই দাঙ্গার দায় অস্বীকার করে আসছেন এবং তার মতে, গুজরাট দাঙ্গার প্রসঙ্গ শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে সামনে আনা হয়। তবে সত্যিই তিনি সম্পূর্ণ দায়মুক্ত কি না, তা নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি।
মন্তব্য করুন