ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ২০২৪ সালে দেশটিতে রেকর্ড করা বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের সংখ্যা ১ হাজার ১৬৫টি, যা আগের বছরের তুলনায় ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। একটি নতুন গবেষণা প্রতিবেদনে এই উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে।
ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব অর্গানাইজড হেট’-এর একটি প্রকল্পের অধীনে ‘ইন্ডিয়া হেট ল্যাব’ নামের সংস্থাটি এই গবেষণা পরিচালনা করে।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে ভারতে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের ৮৮ দশমিক ৫ শতাংশ মুসলিমদের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ১০ শতাংশ বিদ্বেষমূলক বক্তব্য খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে করা হয়েছে।
বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বেশি
সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০২৪ সালে ভারতে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের ৮০ শতাংশই বিজেপিশাসিত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোতে রেকর্ড করা হয়েছে। বিশেষত উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশ—এই তিন রাজ্যেই মোট বিদ্বেষমূলক ঘটনার অর্ধেকের বেশি সংঘটিত হয়েছে।
বিজেপির বিরোধী দলগুলোর শাসিত রাজ্যগুলোতেও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের ঘটনা ঘটেছে, তবে এর পরিমাণ তুলনামূলক কম। বিরোধী দল শাসিত রাজ্যগুলোতে ২৩৪টি বা ২০ শতাংশ বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে।
নির্বাচনের সময় বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের ঊর্ধ্বগতি
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। মোট ঘটনার ৩২ শতাংশই নির্বাচনকেন্দ্রিক সময়ের মধ্যে ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা নির্বাচনী প্রচারণা এবং রাজনৈতিক মেরুকরণের একটি অংশ হয়ে উঠেছে।
সহিংসতাকে উসকে দেওয়ার মতো বক্তব্য
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০২৪ সালে ২৫৯টি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য সরাসরি সহিংসতাকে উসকে দেওয়ার মতো ছিল, যা মোট ঘটনার ২২ শতাংশ। এর মধ্যে ২২৪টি ঘটনা বিজেপিশাসিত রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ঘটেছে। ২০২৩ সালের তুলনায় এই ধরনের বক্তব্য ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে।
‘ডেঞ্জারাস স্পিচ প্রজেক্ট’-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, এই ধরনের বক্তব্য জনসাধারণকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিতে পারে এবং অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আক্রমণকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে।
সামাজিক মাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ
বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রতিবেদনটিতে কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৯৯৫টি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম এবং এক্স (সাবেক টুইটার) মাধ্যমে শেয়ার বা লাইভ-স্ট্রিম করা হয়েছে।
এই প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও, বিদ্বেষমূলক কনটেন্ট সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
গবেষকদের পর্যবেক্ষণ
গবেষণা পরিচালনাকারী সংস্থা ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব অর্গানাইজড হেট’-এর নির্বাহী পরিচালক রাকিব হামিদ নাইক বলেন, আমাদের প্রতিবেদন স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এটি একটি নির্দিষ্ট ধারা অনুসরণ করে ঘটছে।
এটি এখন শুধু সম্প্রদায়গত মেরুকরণের হাতিয়ার নয় বরং ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি, নির্বাচনী প্রচারণা, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং সামাজিক বাস্তবতার অংশ হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, মোদি সরকারের ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতিকরণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিরোধী দলগুলোর নেতারাও মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের প্রকাশ্য নিন্দা করতে পিছিয়ে যাচ্ছেন।
উদ্বেগ বাড়ছে আন্তর্জাতিক মহলে
ভারতে সংখ্যালঘু বিদ্বেষের এই ঊর্ধ্বগতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে।
সূত্র: রয়টার্স, ইন্ডিয়া হেট ল্যাব
মন্তব্য করুন