সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে ঘটে চলা রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এসেছে—ইসরায়েল ও তুরস্ক কি সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে? ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে আলাদা অবস্থানে থাকা এ দুই রাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন ইস্যুতে মুখোমুখি থাকলেও সরাসরি সংঘাতে জড়ানোর নজির নেই। সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যেও দুই দেশ কখনোই যুদ্ধ বেছে নেয়নি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে সিরিয়ায় নতুন সরকার গঠনের পর পরিস্থিতি আরও সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। দুদেশের মধ্যে এ উত্তেজনা কি যুদ্ধে রূপ নেবে? নাকি কূটনৈতিক সমঝোতার দিকেই অগ্রসর হবে তুরস্ক ও ইসরায়েল?
কৌশলগত অবস্থান ও সামরিক শক্তির ভারসাম্য
তুরস্ক ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তি। তাদের সামরিক সক্ষমতা, ভূরাজনৈতিক অবস্থান ও কৌশলগত মনোভাব একে এ অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত করেছে। অপরদিকে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে প্রযুক্তিগত দিক থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রভাবশালী। তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, গোয়েন্দা সক্ষমতা ও আক্রমণের কৌশল একে ভয়ংকর অবস্থায় নিয়ে গেছে।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এ দুটি শক্তিধর দেশের মধ্যে যদি কোনো সামরিক সংঘর্ষ ঘটে, তা শুধু এই দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যেই অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে। তাই উভয় দেশ আপাতত সংঘাত নয়, বরং কূটনৈতিক আলোচনার পথেই অগ্রসর হচ্ছে।
সিরিয়ার ভূরাজনীতিতে দুদেশের অবস্থান
সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতনের পর নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এ পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে সিরিয়ায় নতুন করে সামরিক উত্তেজনা শুরু হয়েছে। ইসরায়েল অভিযোগ করছে, সিরিয়ায় ইরানপন্থী গোষ্ঠী এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠন গোপনে শক্তি সংগ্রহ করছে, যা তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
ইসরায়েলের একটি গবেষণা কমিটি সতর্ক করেছে, সুন্নি মুসলিমশাসিত সিরিয়া ইরানের চেয়েও বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
অপরদিকে তুরস্ক সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই সামরিকভাবে সক্রিয়। তারা একদিকে কুর্দি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে, অপরদিকে সিরিয়ার নতুন সরকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতেও সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। তাদের অভিপ্রায় হলো একটি গণতান্ত্রিক, বেসামরিক ও এককেন্দ্রিক সিরিয়া প্রতিষ্ঠা, যেখানে পিকেকে বা কুর্দি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীগুলো ছোট ছোট রাষ্ট্র গঠন করতে না পারে। এ প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল-তুরস্কের সংঘর্ষের সম্ভাবনা দেখা দিলেও দুদেশেরই কৌশলগত অবস্থান থেকে এ সংঘর্ষ এড়িয়ে চলার পক্ষে।
কূটনৈতিক সংযোগ ও গোপন আলোচনা
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আজারবাইজানে গোপনে আলোচনায় বসেছে ইসরায়েল ও তুরস্কের প্রতিনিধিরা। তাদের লক্ষ্য—সিরিয়ার মাটিতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি বা সংঘর্ষ যেন না ঘটে, সে ব্যাপারে একটি চ্যানেল খোলা রাখা। দুই দেশের মধ্যে এই ধরনের সরাসরি যোগাযোগের চ্যানেল স্থাপন প্রমাণ করে যে উভয় পক্ষই কৌশলগতভাবে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথেই এগোতে চায়।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদানও এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবে বলেছেন, তারা সিরিয়ায় কোনো সংঘর্ষ চান না। বরং তারা একটি স্থিতিশীল সিরিয়া দেখতে চান, যেখানে কেউ কারও জন্য হুমকি হয়ে উঠবে না। একইসঙ্গে তিনি ইসরায়েলকে সতর্ক করেছেন সিরিয়ায় বারবার হামলা চালানো বন্ধ করতে।
ট্রাম্পের ভূমিকা: মধ্যস্থতায় প্রস্তুতি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের যদি কোনো সমস্যা হয়, তাহলে তিনি তা সমাধানে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত। ট্রাম্পের মতে, এরদোয়ান একজন শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান নেতা, যিনি মধ্যপ্রাচ্যে ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র—যা উভয় দেশেরই প্রধান মিত্র—তারা এই অঞ্চলে কোনো সামরিক সংঘর্ষ চায় না। বরং মধ্যস্থতার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানেই আগ্রহী।
গাজায় গণহত্যা এবং তুরস্কের অবস্থান
২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েলের হামলার পর থেকে তুরস্ক কড়া অবস্থান নিয়েছে। তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা করেছে, সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করেছে এবং নিজেদের জনগণের সামনে কড়া ভাষায় ইসরায়েলের সমালোচনা করেছে।
এরপরও বাস্তবতা হলো, তুরস্ক এখনো সরাসরি সংঘাতের পথ বেছে নেয়নি। জনতুষ্টিমূলক বক্তব্য দিলেও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে তারা অনেক বেশি পরিপক্ব অবস্থান নিয়েছে। কারণ তারা জানে, একটি যুদ্ধ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে তাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
ইসরায়েলের দৃষ্টিকোণ
ইসরায়েল মনে করে, একটি খণ্ড বিখণ্ড সিরিয়া তাদের জন্য উপকারী। তারা চায় না, একটি শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ ও গণতান্ত্রিক সিরিয়া আবার মধ্যপ্রাচ্যে মাথা তুলে দাঁড়াক। সেই জন্য তারা সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে রাখতেই হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদে তাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ বিভক্ত সিরিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীর জন্য আদর্শ প্রজননভূমি হয়ে উঠবে, যা পরে ইসরায়েলসহ গোটা অঞ্চলের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।
ভারসাম্য রক্ষায় তুরস্ক
তুরস্ক বর্তমানে সিরিয়ার রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে চাচ্ছে। তারা সিরিয়ার সঙ্গে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে যোগাযোগ রাখছে। একদিকে সিরিয়ার সরকারকে সহযোগিতা করছে, অন্যদিকে এইচটিএসের মতো গোষ্ঠীকে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষ না করার পরামর্শ দিচ্ছে। একইসঙ্গে দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়মিত যোগাযোগে রয়েছে, যাতে কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা না ঘটে।
তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতি এখন অনেক বেশি বাস্তববাদী ও অঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষার পক্ষে। তারা নিজেরা বুঝে গেছে, সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য অপরিহার্য। একদিকে সিরিয়ার পুনর্গঠন, অন্যদিকে নিজ দেশের অভ্যন্তরে থাকা লাখ লাখ সিরিয়ান শরণার্থীর চাপ—এই দুই দিক সামলাতে হলে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষ না হওয়াই ভালো।
শেষ কথা
সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি ও তাতে উভয় দেশের সম্পৃক্ততা নিয়ে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তা এখনও সীমিত পর্যায়েই রয়েছে। যদিও রাজনৈতিক বক্তব্যে উত্তেজনা ছড়ানো হয়, বাস্তবে তারা অনেক বেশি হিসেব-নিকেশ করে চলছে। কিন্তু কূটনৈতিক উদ্যোগ ব্যর্থ হলে, সংঘাতের ঝুঁকি অস্বীকার করা যায় না। সেজন্য প্রয়োজন আরও দৃঢ়, বাস্তববাদী ও আন্তরিক আলোচনার।
ইসরায়েল ও তুরস্ক যদি সত্যিই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা চায়, তাহলে সংঘর্ষ এড়িয়ে কূটনীতি ও সহযোগিতার পথেই তাদের অগ্রসর হওয়া উচিত।
মন্তব্য করুন