তুরস্কে গণতন্ত্রের অবস্থা দিন দিন সংকটাপন্ন হয়ে উঠছে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ধীরে ধীরে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা সংস্থা এবং গণমাধ্যমের ওপর তার সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণের ফলে দেশটি কার্যত স্বৈরতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট চলমান তুরস্কের আন্দোলন নিয়ে করা এক নিবন্ধ থেকে এ তথ্য জানা যায়।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে দেশটির সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে এরদোয়ান নিজের ক্ষমতাকে প্রায় সীমাহীন করে তুলেছেন। এরপর থেকেই তুরস্কে বিরোধী দল, মুক্ত গণমাধ্যম ও স্বাধীন বিচার বিভাগের অস্তিত্ব ক্রমেই সংকুচিত হয়েছে।
এতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা তুরস্ককে ‘প্রতিযোগিতামূলক স্বৈরতন্ত্র’ বলে অভিহিত করতেন—যেখানে বিরোধী দল তত্ত্বগতভাবে নির্বাচন জিততে পারে, যদিও প্রশাসনিক বাধা ও কারসাজির মুখোমুখি হতে হয়। তবে সাম্প্রতিক ঘটনা সেই ধারণাকে নড়বড়ে করে দিয়েছে।
এর আগে বুধবার (১৯ মার্চ) ইস্তাম্বুলের জনপ্রিয় মেয়র একরেম ইমামোগলুর গ্রেপ্তারের ঘটনা তুরস্কের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ইমামোগলু ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছিলেন। গত বছর তার দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) স্থানীয় নির্বাচনে এরদোয়ানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (একেপি) পার্টিকে পরাজিত করেছিল।
দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং দুর্নীতির অভিযোগ এরদোয়ানের জনপ্রিয়তাকে সংকটে ফেলেছে। বিরোধী শিবিরে ইমামোগলুর উত্থান গণতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে কারাগারে পাঠানো এটিই প্রমাণ করে যে, এরদোয়ান গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতেই বেশি আগ্রহী।
এরদোয়ানের শাসনের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, তিনি বহুবার বিরোধীদের দমন করতে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন। ২০১৫ সালে কুর্দিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে বহু নেতাকে কারাগারে পাঠানো হয়। ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর হাজার হাজার মানুষকে আটক করা হয়, যদিও তাদের অনেকেরই অভ্যুত্থানের সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। একই সঙ্গে, সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক সংবাদমাধ্যমগুলো বন্ধ বা কঠোর নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা হয়েছে।
এরদোয়ানের এমন পদক্ষেপ নেওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো, আন্তর্জাতিক মহল এখন অনেকটাই নীরব। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলো বর্তমানে বৈশ্বিক গণতন্ত্রের মানদণ্ড রক্ষায় তেমন সক্রিয় নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধ, অভিবাসন সংকট এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা নিয়ে ব্যস্ত।
এদিকে ইমামোগলুর গ্রেপ্তারের পর ইউরোপীয় কমিশন শুধু তুরস্ককে ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে’ বলেছে, যা অত্যন্ত দুর্বল প্রতিক্রিয়া। যদিও ফ্রান্স ও জার্মানি কিছুটা কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তবে ইইউ এখনো তুরস্কের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। তুরস্কের ইইউ সদস্যপদের আবেদন স্থগিত রাখা কিংবা এরদোয়ানের কৌশলগত স্বার্থে আঘাত হানার মতো কঠোর পদক্ষেপ এখনো গ্রহণ করা হয়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো এরদোয়ানকে স্বৈরতন্ত্রের পথে এগোনো থেকে বিরত রাখতে পারবে না। কেবল তুর্কি জনগণই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই চালিয়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে ইমামোগলুর গ্রেফতারের প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে এবং পুলিশি দমন-পীড়নের মুখোমুখি হচ্ছে।
তবে বাস্তবতা হলো, গণতান্ত্রিক বিশ্ব হয়তো তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করবে, কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে, তুরস্কের গণতন্ত্র এরদোয়ানের হাতেই বন্দি থেকে যাবে কিনা, তা নির্ভর করছে দেশটির জনগণের প্রতিরোধ ও গণআন্দোলনের শক্তির ওপর।
মন্তব্য করুন