বিশ্বে রাজনীতি ও ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক এখন এক ভিন্ন মোড়ে চলে এসেছে। আমেরিকার বর্তমান প্রশাসন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি গ্রহণ করেছে। দীর্ঘদিনের পথচলার সঙ্গী ইউরোপের প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলার মনোভাব দেখাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে ইউরোপের জন্য এক নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। মূল কারণ হলো ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কারণেই ইউরোপীয় দেশগুলোর নিরাপত্তা ও কৌশলগত অবস্থান এখন বড় এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
ট্রাম্প প্রশাসনের নেতৃত্বে আমেরিকার ভূমিকা ও প্রভাব ইউরোপের ওপর কমে আসছে। ফলে ইউরোপকে নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে নজর দিতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় দেশগুলোর সামনে কঠিন প্রশ্ন— তারা কি একলা চলবে, নাকি তাদের উচিত আমেরিকার নেতৃত্বের ওপর ভর করা? অন্যদিকে আমেরিকা কি ইউরোপকে বাদ দিয়ে নিজে ভালো থাকতে পারবে? বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের এই পরিস্থিতি নিয়েই এ প্রতিবেদন।
আমেরিকা ফার্স্ট নীতি
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন শুরু থেকেই একপেশে, একক নীতি অনুসরণ করেছে—‘আমেরিকা প্রথম’। এটি ইউরোপের জন্য নতুন সংকট তৈরি করেছে। ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নয়, বরং তাদের নিজস্ব স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। আমেরিকা এখন ইউক্রেনের সংকটকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, বরং নিজের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে দেখছে। আর ইউরোপের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয় হলো—এখন তারা কী করবে? ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত রাখতে ইউরোপ এখন কার্যকরী পদক্ষেপ খুঁজছে। ইউরোপীয় নেতারা আশঙ্কা করছেন, আমেরিকা তাদের পাশে না থাকলে, নিজেদের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ কারণে ইউরোপীয় দেশগুলো এখন নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে গভীর চিন্তায় পড়ছে।
ইউরোপকে চাপ
ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমেরিকা এখন ইউরোপের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, ইউক্রেনের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ইউরোপকেই নিতে হবে। কিন্তু ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে সামরিক শক্তির জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি বা সমন্বয় নেই। তাদের সেনাবাহিনী, অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক কৌশল যথেষ্ট শক্তিশালী না হওয়ায় ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ইউরোপীয় নেতারা এখন বুঝতে পারছেন, তাদের নিজস্ব ঐক্য, শক্তি ও পরিকল্পনা এখন বেশি প্রয়োজন।
ইউরোপ কী করবে
ইউরোপের এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো নিজেদের সামরিক শক্তি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা। বিশেষ করে আকাশ প্রতিরক্ষা, সাইবার নিরাপত্তা ও পারমাণবিক অস্ত্রশক্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে এখনও ঐক্যবদ্ধ সামরিক পরিকল্পনা বা কৌশল নেই, যা তাদের জন্য ভবিষ্যতের বড় বিপদ। তারা যদি একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় না করে, তাহলে ইউরোপীয় নিরাপত্তা বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। ইউরোপের প্রতিরক্ষা শক্তি তৈরির জন্য অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ছাড়া ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা অন্ধকার হতে পারে।
রাশিয়ার প্রভাব
এখন ইউরোপের কাছে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ। ট্রাম্প প্রশাসন আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে চুক্তি করতে চায়, যা ইউরোপের জন্য বড় হুমকি তৈরি করতে পারে। ইউরোপীয় নেতারা জানেন, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে তাদের অংশগ্রহণ না থাকলে রাশিয়ার প্রভাব ইউরোপে বাড়বে। এটি তাদের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। কারণ ইউক্রেনের স্বাধীনতা যদি রাশিয়ার সঙ্গে কোনো চুক্তিতে শেষ হয়, এতে ইউরোপের ভূরাজনৈতিক অবস্থান চ্যালেঞ্জে পড়বে।
চীন-ভারতের দৌরাত্ম্য
বৈশ্বিক ভারসাম্য এখন ইউরোপের জন্য উদ্বেগ তৈরি করছে। চীন ও ভারত দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করে আসছে, এখন এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি থেকে লাভবান হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। চীন ও ভারত মনে করছে, ইউরোপের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের ভাঙন ঘটলে তাদের শক্তি আরও দৃঢ় হবে। এ কারণে ইউরোপীয় দেশগুলো এখন নিজেদের শক্তি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করছে, পাশাপাশি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রস্তুত হচ্ছে।
আমেরিকার ভূমিকা কমছে
আমেরিকা ফার্স্ট নীতির কারণে বিশ্বে আমেরিকার নেতৃত্বের ভূমিকা কমছে। শুধু ইউরোপ নয়, আমেরিকা তাদের এই নীতির কারণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সংহতির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করা হচ্ছে। যেমন, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি এবং ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছে আমেরিকা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের অন্যান্য দেশ বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া তাদের অবস্থান শক্তিশালী করছে।
এই নীতির ফলে ইউরোপের বাইরেও ঐতিহ্যবাহী মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। ইউরোপ ও অন্যান্য দেশগুলো এখন একা তাদের নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা করছে। কারণ তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, আমেরিকা তাদের পাশে নেই। এর ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। আর এ অস্থিরতার কারণে ভবিষ্যতে আমেরিকার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। এ ছাড়া আমেরিকা ফার্স্ট নীতি বিশ্ব বাণিজ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। এটি আমেরিকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও বাধা সৃষ্টি করতে পারে। কারণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষতি হলে, আমেরিকার অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তথ্যসূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান, সিইপিএ
মন্তব্য করুন