কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০২:২৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বিদ্রোহীদের হামলায় নাজেহাল মিয়ানমারের জান্তা

জান্তার সাথে সংঘর্ষে বিধ্বস্ত বসতি। ছবি : সংগৃহীত।
জান্তার সাথে সংঘর্ষে বিধ্বস্ত বসতি। ছবি : সংগৃহীত।

উত্তাল মিয়ানমারের রাজনীতি। দেশটিতে দানা বেধেছে বিদ্রোহীদের আন্দোলন। ভয়াবহ বিপাকে পড়তে শুরু করেছে জান্তা সরকার। শক্তিশালী হয়ে উঠছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী। চলমান হামলায় একাধিক শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিদ্রোহীরা। এছাড়া দখল করেছে শতাধিক সামরিক চৌকি। এমনকি একটি শহরে শুরু হয়েছে বেসামরিক শাসন।

গত কয়েক মাস ধরে চলা সংঘর্ষে সেনাবাহিনীর একের পর এক জওয়ান ও ঘাঁটি হারাচ্ছে। এর জেরে পতনের দ্বারপ্রান্তে জান্তা বলেন মন্তব্য করছেন বিশ্লেষকরা। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে জান্তা। এরপর প্রথমবারের মতো মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছে তারা। বিদ্রোহীদের হামলায় প্রতিনিয়ত সেনারা তাদের ঘাঁটি হারাচ্ছে। এমনকি বিদ্রোহীদের হামলা এতটা জোরদার হয়েছে যে সেনারা একের পর এক প্রাণ হারাচ্ছে ও আত্নসমর্পণে বাধ্য হচ্ছে। জান্তার চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠছে বিদ্রোহীরা।

অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই শুরু হয়ে। এতে যোগ দেন লাখ লাখ মানুষ। মিয়ানমারে শুরু হয় ভয়াবহ সংঘর্ষ। এতে অস্ত্র হাতে নিয়ে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যোগ দেন বেসামরিক নাগরিকেরা। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব বাহিনী ও পদচ্যুত নির্বাচিত নেতাদের নিয়ে গঠিত হয় দ্য পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ)।

সাম্প্রতিক আন্দোলনে পিডিএফসহ বিদ্রোহীরা ব্যপক সফলতা অর্জন করেছে। এরমধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), দ্য তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং দ্য আরাকান আর্মি (এএ) মিলে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গঠিত হয়। এ জোট গত ২৭ অক্টোবর জান্তার বিরুদ্ধে শান রাজ্যে সমন্বিত হামলা চালায়। এরপর থেকে বেশ কিছু রাজ্যসহ সেনা চৌকি দখলে নেয় তারা।

১০ দিনের ব্যবধানে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স মিলে শতাধিক সামরিক ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে। এছাড়া তারা দেশটির বেশ কয়েকটি মহাসড়ক ও সীমান্ত ক্রসিং দখলের দাবি করেছে। বিদ্রোহীদের জোটবন্ধ আন্দোলনে বড় বিপর্যয়ের মুখে দেশটির জান্তা।

মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন মার অং চলতি সপ্তাহে নিক্কেই এশিয়াকে বলেছেন, সেনাদের মনোবল ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। কারণ অনেকেই দলত্যাগ করছে। এমনকি বেশির ভাগ সামরিক ক্যাম্প আত্মসমর্পণ করতেও প্রস্তুত।

বিভিন্ন শহর দখল ও অবরুদ্ধ

কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) এবং পিডিএফ বাগো অঞ্চলের কিয়াউকগি টাউনশিপের মোনে টাউনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে কেএনইউ যোদ্ধারা পূর্ব কারেন রাজ্যের কাওকারিক শহরে হামলা চালিয়ে আসছে। এছাড়া সামরিক বাহিনী ও কেএনইউর মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলা লড়াইয়ে ইয়াঙগুন ও মায়াওয়াদির মধ্যবর্তী এ এলাকা প্রতিনিয়ত অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকে। এ অঞ্চলটি থাইল্যান্ডের সাথে মিয়ানমারের থাকা ছয়টি সরকারি সীমান্তের মধ্যে অন্যতম এবং দ্বিতীয় ব্যস্ততম সীমান্ত বাণিজ্যকেন্দ্র।

কেএনএলএ ও পিডিএফ বাগো অঞ্চলের কিয়াউক্কি টাউনশিপের মোনেতে একটি সামরিক চেকপয়েন্টে হামলা চালিয়েছে। এতে উভয়পক্ষের ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া বিদ্রোহীদের হামলার মুখে বিপুলসংখ্যক জান্তা সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। মোন শহরটি জান্তার স্নায়ুকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।

এছাড়া মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী কোকাং স্বশাসিত অঞ্চলের প্রশাসনিক কেন্দ্র লাউক্কাইং শহর দখলের জন্য জান্তার ঘাঁটিতে আক্রমণ আক্রমণ চালিয়েছে বিদ্রোহীরা। এ অঞ্চলে মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) পাঁচ দিন সংঘর্ষের পর কনকিয়ান টাউনশিপ দখল করে নেয়। এ শহরটি ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জান্তার নিয়ন্ত্রণে ছিল।

অন্তত ২০০ জান্তা ঘাঁটি দখল

মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) ও মিত্র দল মিলে শান রাজ্যের বিশেষ অঞ্চল ১-এর লাউক্কাইং টাউনের আশেপাশের ২০০টিরও বেশি জান্তা ঘাঁটি দখলের দাবি করেছে। এছাড়া তারা বেশ কয়েকটি কৌশলগত শহরও দখল করেছে। বিদ্রোহীদের সাথে সংঘর্ষের কারণে রাখাইনে স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। রাজ্যের পাউকতাও, মিনবায়া, রাথেডং ও মংডু শহরে আরাকান আর্মি (এএ) সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

সংঘর্ষে অর্থনৈতিক প্রভাব

বিদ্রোহীদের সাথে চলমান সংঘর্ষে রাজ্যে খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। রাখাইনে জান্তার অবরোধের নকারণে সেখানেসব পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এছাড়া রাজ্যের ৩০ লাখের বেশি মানুষ প্রায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকটে ভূগছে।

অবরোধের ফলে সিটওয়ে-ইয়াঙগুন মহাসড়ক দিয়ে পণ্য সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। সরবরাহ বন্ধের কারণে পণ্যের দামও বেড়েছে। জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং বলেছেন, আরাকান আর্মির সৃষ্ট সংকটের কারণে রাজ্যের বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ম্রাউক-ইউ, কিয়াউকতাও ও পালেতওয়া শহরে সহিংসতা সৃষ্টি হয়েছে।

আরাকান আর্মি (এএ) জানিয়েছে, রাথেডং, মংডু ও মিনবাইয়া শহরে পাঁচটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলার মাধ্যমে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। এরপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণের কারণে সরকার প্রায় ২০টি শহর এবং ৩০৩টিরও বেশি ফাঁড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। পুরো ব্যাটালিয়নসহ শত শত জান্তা সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে।

বেসামরিক প্রশাসন

মিয়ানমারের গুরুত্বপূর্ণ শহর ইয়াঙগুন ও মান্দালয়ের বাসিন্দারা এ অবস্থার মধ্যে বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করছে। পিডিএফ ও ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ৪ নভেম্বর সাগাইং অঞ্চলের কাওলিন শহরটি দখল করে নিয়েছে। এরপর শহরটিতে ৩ ডিসেম্বর থেকে বেসামরিক প্রশাসনের অধীনে কার্যক্রম চলছে। এ প্রশাসনের অধীনে সেখানকার বাজারগুলোও আবার খোলা হয়েছে। দেশটিতে চলমান সেনাশাসনের শুরু থেকে মিয়ানমারের ওপর পশ্চিমা চাপ অব্যাহত রয়েছে। চীন, রাশিয়া ও ভারত মিয়ানমারকে নানাভাবে সমর্থন দিলেও এ পরিস্থিতি তাদের বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে।

চীনকে অনুরোধ মিয়ানমারের

মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতী জানিয়েছে, যুদ্ধ বন্ধ করে জান্তার সাথে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে চাপ দিতে চীনকে অনুরোধ করেছে মিয়ানমার। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে জান্তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী থান শোয়ে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সকে আলোচনায় আনার জন্য এ অনুরোধ করেন। গত ২৭ অক্টোবর এই এ জোট মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন ১০২৭ শুরু করে।

বৈঠক শেষে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বৈঠকে ওয়াং ই বলেছেন, চীন আশা করে মিয়ানমারে শিগগিরই জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতা শুরু হবে এবং দেশের সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক রূপান্তর সূচিত হবে।’ এ ছাড়া চীনা একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছে, জান্তা সরকার বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য চীনের সাহায্য কামনা করেছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কোয়ার্টার ফাইনালেই ক্রুসকে অবসরে পাঠাতে চায় স্পেন

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা মিথ্যা : বরকত উল্লাহ বুলু

মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের জন্য এনআইডি কার্যক্রম বিষয়ক মতবিনিময় সভা

অপুকে ছাগলের বাচ্চার সঙ্গে তুলনা করলেন বুবলী

উইম্বলডন ২০২৪ / দ্বিতীয় রাউন্ডে জোকোভিচ, ভন্দ্রোসোভার বিদায়

আওয়ামী লীগ নয়, জিয়া, খালেদা, এরশাদ দেশ বিক্রি করেছেন : প্রধানমন্ত্রী

ফল উৎসব আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ : আব্দুস সালাম 

সমুদ্রসম্পদ আহরণে সব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে : বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী

এমপি আনার হত্যা, যেভাবে পালিয়ে যান ফয়সাল

নতুন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দুই কোরিয়ার

১০

যমুনার গর্ভে বিলীন ৫ শতাধিক বাড়িঘর

১১

প্রধানমন্ত্রীর বেইজিং সফরে উন্নয়ন ইস্যু প্রাধান্য পাবে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

১২

মুম্বাইয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রোহিতদের সংবর্ধনা

১৩

এমপি আনার হত্যা : এবার ফয়সালের দোষ স্বীকার

১৪

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী

১৫

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার পরিকল্পনা নেই : জনপ্রশাসনমন্ত্রী

১৬

দেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিয়েছে সরকার : নিতাই রায়

১৭

সুনীল অর্থনীতিকে মূল অর্থনীতিতে কাজে লাগাতে হবে : প্রতিমন্ত্রী

১৮

আলমগীর হোসেনের ওপর হামলার প্রতিবাদে উদীচীর সমাবেশ

১৯

জামিন পেলেন ছাত্র মৈত্রীর সম্পাদক অদিতি

২০
X