ইরান অনেক বছর ধরেই পশ্চিমা দেশগুলোর বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপোড়েনের মধ্যে আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি নিজেদের সামরিক শক্তিকে একেবারে নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। নতুন ধরনের যুদ্ধজাহাজ, ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা অস্ত্র—এসব মিলিয়ে ইরান এখন মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় শক্তি হয়ে উঠেছে। ইরানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অস্ত্র, সামরিক শক্তি বৃদ্ধির বিশ্লেষণ নিয়ে সাজানো হয়েছে এই প্রতিবেদন।
ইরানের নতুন হাতিয়ার
ইরানের স্থলবাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিয়োমারস হেইদারি সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে জানান, ইরানের কাছে এমন কিছু অস্ত্র আছে যেগুলো এখনো প্রকাশ করা হয়নি। এসব অস্ত্রকে ‘অতিগোপন’ বলা হচ্ছে। তিনি বলেন, এসব অস্ত্র দেখতে সাধারণ অস্ত্রের মতো হলেও এতে যুক্ত করা হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি। এর ফলে এসব অস্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে চিন্তা করতে পারে, লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারে, এমনকি সিদ্ধান্তও নিতে পারে। তিনি আরও বলেন, ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর থেকে ইরানের সেনাবাহিনী একেবারে বদলে গেছে। আগের দিনের ধীর, সাদামাটা বাহিনী এখন আধুনিক ও দ্রুতগতির বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। সেনারা এখন যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় পৌঁছাতে পারে, দ্রুত হামলা চালাতে পারে এবং জরুরি পরিস্থিতিতে কাজ করতে পারে।
গোয়েন্দা প্রযুক্তিতে ইরানের উন্নতি
বর্তমানে ইরানের সেনাবাহিনী পুরো দেশজুড়ে নজরদারি চালাতে পারে। তাদের কাছে আছে উন্নত ক্যামেরা, ড্রোন ও স্যাটেলাইট প্রযুক্তি। সীমান্ত এলাকাগুলোতে মোতায়েন করা আছে ১০টি সামরিক ইউনিট, যারা একদিকে সীমান্ত নিরাপত্তা রক্ষা করছে, অন্যদিকে শত্রুর গতিবিধি নজরে রাখছে। এই সব ইউনিটের কাজ শুধু যুদ্ধ করা নয়, বরং যুদ্ধের আগেই বিপদ চিহ্নিত করা, কৌশল তৈরি করা এবং প্রস্তুত থাকা। যদিও এর মানে এই নয় যে ইরান এখন পুরোপুরি নিরাপদ, তবে তারা এখন যে কোনো হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে প্রস্তুত।
সামরিক মহড়া ও প্রস্তুতির বার্তা
গত পারস্য বর্ষপঞ্জির শেষ কয়েক মাসে ইরান পূর্ব, পশ্চিম ও উপকূলীয় এলাকায় তিনটি বড় সামরিক মহড়া চালিয়েছে। এই মহড়াগুলোর মাধ্যমে সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি, সমন্বয় এবং প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে। এ মহড়া শুধু দেশীয় জনগণের কাছে বার্তা নয়, বরং বাইরের শক্তিগুলোকেও বোঝানো হয়েছে—ইরান এখন পুরোপুরি প্রস্তুত।
ইরানের সেনাবাহিনী এখন একটি শক্তিশালী, উন্নত ও আত্মনির্ভর বাহিনী। অন্য দেশগুলো এখন ইরানের সেনাবাহিনীকে অনুসরণ করতে পারে। এর মানে ইরান শুধু নিজের জন্য শক্তি তৈরি করছে না, বরং এটি এক মডেল হয়ে উঠছে বিশ্বের জন্য।
সাইবার যুদ্ধ: ইরানের নতুন যুদ্ধক্ষেত্র
বর্তমান সময়ে যুদ্ধ শুধু মাটিতে বা আকাশে হয় না, হয় ইন্টারনেটেও। এটাকে বলে সাইবার যুদ্ধ। এখানে হ্যাকিং, তথ্য চুরি, নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি কাজ করা হয়। হেইদারি জানান, ইরান এখন আলাদা সাইবার ইউনিট তৈরি করেছে। এই ইউনিট অনেক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং শত্রুর ডিজিটাল সিস্টেমে আঘাত হানতে সক্ষম।
এ ইউনিট শুধু প্রতিরক্ষা নয়, বরং আক্রমণ চালানোর সক্ষমতাও রাখে। ইরান চাইলে প্রতিপক্ষের সামরিক কম্পিউটার সিস্টেম, যোগাযোগ ব্যবস্থা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ডেটা হ্যাক করতে পারে।
নতুন যুদ্ধজাহাজ: ‘শহীদ বাঘি’ প্রকল্প
ইরান এখন একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজ তৈরি করেছে, যার নাম ‘শহীদ বাঘি’। এটি শুধু একটি জাহাজ নয়—এটি হলো একটি ভ্রাম্যমাণ নৌঘাঁটি। এই জাহাজ থেকে ড্রোন উড়ানো যাবে, ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া যাবে এবং এটি সমুদ্রের ওপর চলমান ঘাঁটির মতো কাজ করবে। জাহাজটিতে দুইটি ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার থাকবে এবং ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপকারী ভেসেল বহন করতে পারবে। আইআরজিসি নৌবাহিনীর প্রধান আলী রেজা তাংসেরি বলেন, এই জাহাজ যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো যুদ্ধজাহাজের চেয়েও উন্নত।
তিনি আরও বলেন, আগে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তেলবাহী ট্যাংকারে হামলার সাহস করত। এখন আর করে না। যদি কখনও করে, তাহলে ইরান সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টা জবাব দেবে।
পারস্য উপসাগরে শক্তির ভারসাম্য বদলাচ্ছে
পারস্য উপসাগর হলো পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ। এখান দিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ ব্যারেল তেল পরিবহন হয়। বহু বছর ধরে এখানে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী একচেটিয়া আধিপত্য করে আসছে। কিন্তু এখন ইরান বলছে—এই দিন শেষ। ইরান এখন নিজের সামরিক শক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চাইছে যে, তারা শুধু নিজেদের রক্ষা করতে পারে না, বরং আক্রমণও চালাতে পারে। তাদের লক্ষ্য, পারস্য উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা আধিপত্য ভাঙা।
আগে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তেলবাহী ট্যাংকারে হামলার সাহস করত। এখন আর করে না। যদি কখনও করে, তাহলে ইরান সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টা জবাব দেবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কৌশলগত বার্তা
ইরানের সামরিক ঘোষণা কেবল দেশীয় জনগণকে আশ্বস্ত করার জন্য নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কৌশলগত বার্তা পাঠাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, ইসরায়েলসহ অন্য প্রতিবেশী ও প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলো এ বার্তায় নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান এখন এমন এক অবস্থানে পৌঁছেছে যেখানে তারা সংঘাত চাইছে না, তবে যদি সংঘাত হয়, তাহলে তারা পিছিয়ে থাকবে না।
‘ইরানের সেনাবাহিনী অনুকরণীয়’
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেন, ইরানের সেনাবাহিনী এখন একটি শক্তিশালী, উন্নত এবং আত্মনির্ভর বাহিনী। তিনি বলেন, অন্য দেশগুলো এখন ইরানের সেনাবাহিনীকে অনুসরণ করতে পারে। এর মানে ইরান শুধু নিজের জন্য শক্তি তৈরি করছে না, বরং এটি এক মডেল হয়ে উঠছে বিশ্বের জন্য।
আইআরজিসি ও স্থলবাহিনীর একত্রীকরণ
ইরানের স্থলবাহিনী এবং বিপ্লবী গার্ড বাহিনী এখন একসঙ্গে কাজ করছে। তারা আকাশ, স্থল এবং সমুদ্রপথে একে অপরকে সহযোগিতা করছে। এতে ইরানের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা আরও শক্তিশালী হয়েছে। আগের চেয়ে এখন ইরান অনেক বেশি সমন্বিত ও কার্যকর একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছে।
যুদ্ধ কি এবার পারস্য উপসাগরে?
ইরান তার নতুন এআইচালিত অস্ত্র, সাইবার ইউনিট ও আধুনিক যুদ্ধজাহাজ দিয়ে প্রমাণ করতে চাইছে যে, তারা শুধু প্রতিরক্ষা নয়—প্রয়োজনে আক্রমণ চালাতে সক্ষম। এর ফলে পারস্য উপসাগরে যে দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা আধিপত্য ছিল, সেটি এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশ্ব রাজনীতি বর্তমানে খুবই অস্থির সময় পার করছে। এর মধ্যে ইরানের এমন সামরিক ঘোষণা শুধু একটি দেশ নয়, পুরো অঞ্চল এবং বিশ্বের জন্যই নতুন বার্তা বয়ে আনছে। তেহরান আজ এমন একটি অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে তারা শুধু কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করতে চায়। বোঝাতে চায়, এখন আর একতরফা আধিপত্যের দিন নেই।
মন্তব্য করুন