আমিনা তখন মাত্র ১২ বছর বয়সী। স্কুলের নতুন বইয়ের ঘ্রাণ, বন্ধুদের সাথে ক্লাসে হাসি-আনন্দ, শিক্ষকদের শিখিয়ে দেওয়া নতুন নতুন পাঠ—সব মিলিয়ে পড়াশোনা ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। কিন্তু একদিন সকালে বাবা জানালেন, সে আর স্কুলে যেতে পারবে না। তালেবান সরকার নতুন নিয়ম জারি করেছে, যেখানে ১২ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ।
সেই মুহূর্তটির কথা আজও ভুলতে পারে না আমিনা। তার কচি মনে এক ধাক্কায় যেন স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সে চেয়েছিল ডাক্তার হতে। ছোটবেলায় হৃদরোগজনিত জটিলতার কারণে তাকে অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল।
এক নারী সার্জনের দক্ষ হাত তাকে নতুন জীবন দিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতাই তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে।
তালেবানের নিষেধাজ্ঞা ও শিক্ষার পথ বন্ধ
২০২১ সালে তালেবান সরকার আফগানিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই নারীদের জন্য একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে থাকে। প্রথমেই বন্ধ করা হয় মেয়েদের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা।
জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, এই নিষেধাজ্ঞার ফলে প্রায় ১০ লাখেরও বেশি আফগান কিশোরী শিক্ষার অধিকার হারিয়েছে।
প্রথম দিকে তালেবান দাবি করেছিল, এই নিষেধাজ্ঞা অস্থায়ী এবং একটি ‘ইসলামিক’ পাঠ্যক্রম তৈরির পর স্কুলগুলো আবার চালু হবে। কিন্তু চার বছর পার হলেও এখনো মেয়েদের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা চালু হয়নি।
মাদ্রাসা ছাড়া শিক্ষার আর কোনো পথ নেই
বর্তমানে আফগানিস্তানে অনেক নারী ও কিশোরীর জন্য একমাত্র শিক্ষার পথ হলো মাদ্রাসা। তবে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র ইসলামিক শিক্ষা প্রদান করে। যেসব পরিবার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল, তারা ব্যক্তিগত টিউটরের মাধ্যমে মেয়েদের গণিত, বিজ্ঞান ও ভাষার মতো বিষয় শেখানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এটি সবার জন্য সম্ভব নয়।
আমিনা বর্তমানে কাবুলের আল হাদিস মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। ঠাণ্ডা ও স্যাঁতস্যাঁতে একতলা ভবনের নিচে গাদাগাদি করে বসে থাকে শত শত মেয়ে। স্কুলের মতো এখানে নেই কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণিকক্ষ, নেই কোনো মানসম্মত পাঠ্যক্রম। এই মাদ্রাসাটি চালু করেছেন আমিনার ভাই হামিদ, কারণ তিনি তার বোনের শিক্ষাজীবন পুরোপুরি বন্ধ হতে দিতে চাননি।
হামিদ বলেন, ‘যখন আমার বোনের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল, তখন সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। তার হৃদরোগ সার্জন হওয়ার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, কিছু একটা করা দরকার। তাই এই মাদ্রাসাটি চালু করি, যাতে অন্তত কিছুটা হলেও সে পড়াশোনার সুযোগ পায়।’
আফগানিস্তানে নারী শিক্ষা : এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
উল্লেখ্য, আফগানিস্তান বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে মেয়েদের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা নিষিদ্ধ। গত জানুয়ারিতে আফগানিস্তান মানবাধিকার কেন্দ্র একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়, তালেবান সরকারের অনুমোদিত মাদ্রাসাগুলোতে কট্টরপন্থি মতাদর্শ প্রচার করা হচ্ছে।
এছাড়া পাঠ্যক্রমে যুক্ত করা হয়েছে এমন সব বিষয়, যা তালেবানের রাজনৈতিক ও সামরিক কার্যক্রমের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে। এছাড়া, নারী-পুরুষের মেলামেশা নিষিদ্ধকরণ এবং বাধ্যতামূলক হিজাব পরিধানের বিধানও রয়েছে এই পাঠ্যক্রমে।
প্রসঙ্গত, একসময় আফগানিস্তানে নিবন্ধিত মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল প্রায় ৫,০০০, যেখানে কোরআন, হাদিস, শরীয়া আইন ও আরবি ভাষা শেখানো হতো। কিন্তু এখন মেয়েদের জন্য কিছু মাদ্রাসায় রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, গণিত ও ইংরেজি পড়ানোর চেষ্টা করা হলেও তালেবান সরকার সম্প্রতি মেয়েদের জন্য চিকিৎসা প্রশিক্ষণও নিষিদ্ধ করেছে।
আলোর দিশা খুঁজছে মেয়েরা
শেখ আবদুল কাদের জিলানি মাদ্রাসায় ২০ বছর বয়সী হাদিয়া পড়াশোনা করছেন। তিনি বিজ্ঞান ভালোবাসেন এবং গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও ভূগোলের ওপর জ্ঞানার্জন করেছেন। কিন্তু বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে তিনি এখন মাদ্রাসায় কোরআন পড়াচ্ছেন। কারণ, তার পছন্দের বিষয়গুলোর জন্য সমাজে তেমন চাহিদা নেই।
একই মাদ্রাসার আরেক শিক্ষার্থী ১৩ বছর বয়সী তাওকা। তার বড় বোনও এখানে পড়াশোনা করেন। তাওকা বলে, আমি ধর্মীয় শিক্ষা ভালোবাসি। এখানে শেখানো হয়, একজন নারীকে কী ধরনের হিজাব পরতে হবে, পরিবারের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে এবং স্বামী বা ভাইয়ের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক রাখা উচিত।
কিন্তু অনেকেই মনে করেন, শুধু ধর্মীয় শিক্ষা মূলধারার শিক্ষার বিকল্প হতে পারে না। একজন নারী চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক কিংবা বিজ্ঞানী হতে গেলে আধুনিক শিক্ষার বিকল্প নেই।
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও ভবিষ্যৎ
আফগানিস্তানে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি রিচার্ড বেনেট তালেবানের শিক্ষা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, শিক্ষার সীমাবদ্ধতা, উচ্চ বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে দেশটি ধীরে ধীরে উগ্র মতাদর্শের দিকে ঝুঁকতে পারে, যা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হতে পারে।
তালেবান সরকার দাবি করেছে, তারা নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ হলেই মেয়েদের জন্য স্কুল পুনরায় খুলবে। কিন্তু বাস্তবে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
স্বপ্ন ভেঙে গেলেও আশার আলো দেখছে আমিনা
সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতাতেও আমিনা আশা হারাতে চায় না। তার চোখে এখনো সেই স্বপ্ন—একদিন সে একজন ডাক্তার হবে। সে বিশ্বাস করে, তালেবান সরকার একদিন স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা খুলে দেবে এবং তার মতো হাজারো মেয়ের ভবিষ্যৎ আবার আলোর পথে ফিরবে।
কিন্তু সেই দিন কবে আসবে, সে প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে না।
সূত্র : বিবিসি
মন্তব্য করুন