কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৫, ০২:৪৪ পিএম
আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৩:৩২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন

লাল গালিচায় ড. ইউনূসকে বরণের অপেক্ষায় চীন

চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। ছবি : সংগৃহীত
চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। ছবি : সংগৃহীত

আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরে যাবেন। তার এ সফরে লাল গালিচায় উষ্ণ অভ্যর্থনার আয়োজন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি মূলত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চীনের কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা জোরদারের অংশ। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে কূটনীতিক টানাপড়েনের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটতে চলেছে।

শান্তিতে নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূস আগস্ট থেকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ সময়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। ব্যাপক আন্দোলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।

ঢাকা জানিয়েছে, ড. ইউনূস ২৭ মার্চ চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপ প্রদেশ হাইনানে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তৃতা দেবেন। পরের দিন বেইজিংয়ে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথেও দেখা করবেন এবং পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেবেন। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হবে।

দায়িত্ব গ্রহণের পর ড. ইউনূসের প্রথম চীন সফর এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। কারণ সরকার পতনের পর নয়াদিল্লি হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের আশ্রয় দিয়েছে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভারত তাদের প্রায় চার হাজার ১০০ কিলোমিটার সীমান্তে বেড়া দেওয়ার কাজ পুনরায় শুরু করার পর সম্পর্কের আরও অবনতি হয়। সীমান্তে তিন দিকেই কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কাজ শুরু হয়। এ ঘটনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ১২ জানুয়ারি ভারতের হাইকমিশনারকে তলব করে তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। মন্ত্রণালয় জানায়, এর ফলে সীমান্তে উত্তেজনা ও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে ভারত পরের দিন একই পদক্ষেপে দাবি করে যে, বেড়া নির্মাণে সব প্রোটোকল এবং চুক্তি অনুসরণ করা হয়েছে।

উত্তেজনার সর্বশেষ ঘটনা মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্য। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের বিষয়ে ভারতের দাবির সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন। সোমবার নয়াদিল্লিতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে গ্যাবার্ড বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন, হত্যা এবং নির্যাতন ... মার্কিন সরকারের জন্য উদ্বেগের একটি প্রধান বিষয়। তবে তার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তারা জানিয়েছে, কোনো প্রমাণ বা নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে এসব করা হয়নি।

পর্যবেক্ষকদের মতে, ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের আগে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কূটনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে বেইজিংয়ের সমর্থন অনেক সহায়ক হবে। কারণ তিনি প্রধান শক্তিগুলোর কাছ থেকে বৈধতা চান।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেয়ারব্যাঙ্ক সেন্টার ফর চাইনিজ স্টাডিজের অনাবাসিক সহযোগী আনু আনোয়ার বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে তাদের অবশ্যই বেইজিংকে বোঝানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে যে, তারা একটি নির্ভরযোগ্য কূটনৈতিক অংশীদার। তিনি আরও বলেন, তবে বেইজিং সতর্ক অবস্থান নিতে পারে। প্রাথমিকভাবে কূটনৈতিক সৌজন্য বজায় রেখে ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপনের পরিকল্পনা রাখতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড. ইউনূস শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করার সময় চীনা বিনিয়োগ নিশ্চিত করাও আলোচ্যসূচিতে শীর্ষে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০০৬ সালে চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে ভারতকে ছাড়িয়ে যায়। গত বছর দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যার মধ্যে ২২ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল চীনা রপ্তানি।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ বেইজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগদানকারী প্রথম দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হয়ে ওঠে এবং বৈশ্বিক সংযোগ কর্মসূচির আওতায় চীনা বিনিয়োগের একটি প্রধান গ্রাহক হয়ে ওঠে। যা গ্লোবাল সাউথের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য বেইজিংয়ের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।

চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে জড়িত, বিশেষ করে পদ্মা সেতু রেল লিঙ্ক এবং কর্ণফুলী টানেল। ঢাকা এখন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মংলা বন্দরের সম্প্রসারণের জন্য চীনা ঋণ চাইছে। গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা চীনের বাংলাদেশে বিশাল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ নিয়ে উদ্বেগের জন্ম দেয়, যার মধ্যে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি বকেয়া ঋণও রয়েছে।

আনোয়ার বলেন, ইউনূস বেইজিংকে আশ্বস্ত করতে চাইবেন যে, অভ্যন্তরীণ অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে তার অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং কৌশলগত সম্পৃক্ততা সুরক্ষিত রয়েছে।

চীনের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের উপপরিচালক লিন মিনওয়াং বলেন, ড. ইউনূস বেইজিং সফরে হাসিনার সময়ে স্বাক্ষরিত কিছু চুক্তি এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। হাসিনা গত বছরের জুলাইয়ে চীন সফরের সময় উভয় পক্ষ ২০টিরও বেশি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যেখানে বেইজিং ১ বিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ১৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

লিন বলেন, পরিকল্পিত সহযোগিতার অনেকগুলো তখন থেকেই আটকে আছে। আমি মনে করি চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন পুনরায় শুরু করার সময় এসেছে।

হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বেইজিং ঢাকার সঙ্গে তার সম্পর্ক ক্রমাগতভাবে বাড়িয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন অক্টোবরে ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর তিনি ড. ইউনূসসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের পাশাপাশি সামরিক ও প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গেও দেখা করেছেন।

গত সপ্তাহে, বাংলাদেশের একটি মেডিকেল প্রতিনিধিদল দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের কুনমিং শহর পরিদর্শন করেছে। ভারত বাংলাদেশি রোগীদের জন্য তাদের দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর দেশটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসাসেবার বিকল্প সরবরাহকারী খুঁজছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, ড. ইউনূসের সফরের সময় তিস্তা নদীর ব্যবস্থাপনা নিয়েও আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি নদী রয়েছে। এর বেশিরভাগই ভারত থেকে উৎপন্ন, যা নয়াদিল্লিকে প্রতিবেশীদের মধ্যে বৃহত্তর আলোচনায় কিছুটা সুবিধা প্রদান করেছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ চতুর্থ দীর্ঘতম তিস্তা নদীর ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পের ঋণের জন্য চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, যা পরবর্তীতে নয়াদিল্লির সতর্ক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারপর থেকে তিস্তা প্রকল্পে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। যদিও বেইজিং বারবার এই প্রকল্পে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। পরে ভারত এই প্রকল্পটি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে।

প্রকল্পটি দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও ভারতের মধ্যে বিস্তৃত ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে তুলে ধরে, যেখানে উভয় দেশই বাংলাদেশের উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য লড়াই করছে।

লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা কেবল প্রযুক্তিগত ও আর্থিক বিষয় নিয়েই নয়, রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণও হবে। এটি বাংলাদেশ-ভারত-চীনের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি প্রধান বিরোধের বিষয় ছিল। অতএব, যদি এই বিষয়ে কোনো ইতিবাচক অগ্রগতি হয়, তবে এ অঞ্চলে তার কৌশলগত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্জন হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীকে সোচ্চার হতে হবে : খেলাফত মজলিস

রোগী সেজে নেন বাসা ভাড়া, আরসা প্রধান থাকতেন ইমাম পরিচয়ে

বার্ন ইনিস্টিটিউটের ছাদ থেকে ‘লাফিয়ে পড়ে’ রোগীর মৃত্যু

১০ বছর পর অর্ধডজন হত্যা মামলার আসামি গ্রেপ্তার

ইউজিসিতে সাংবাদিকের ওপর হামলাচেষ্টা

হামজাকে বাংলাদেশের মেসি বলে অভিহিত করলেন জামাল

দেশ ও এলাকার জন্য কাজ করে যেতে চাই : ধর্ম উপদেষ্টা

সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে বাফুফেকে কড়া সতর্কবার্তা ক্রীড়া উপদেষ্টার

মোহাম্মদপুরে উদ্বোধন হলো ‘জনতার বাজার’

নতুনভাবে ‘বয়াম পাখি’, সঙ্গে জেফার

১০

সাংবাদিককে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় আসামির স্বীকারোক্তি

১১

ইলিয়াসপত্নীর গাড়ি ভাঙচুর মামলায় যুবলীগ নেতা কারাগারে

১২

ফাহমিদুলকে নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানালেন কোচ ক্যাবরেরা

১৩

‘পুতিন একটি খেলা খেলছেন’

১৪

পুলিশকে প্রস্তুতি নিতে বললেন প্রধান উপদেষ্টা

১৫

কেমন আছে ঢাকায় ধর্ষণের শিকার সেই শিশুটি?

১৬

ভাঙারি দোকানে মর্টার শেল, নিষ্ক্রিয় করল বোম ডিসপোজাল ইউনিট

১৭

সংখ্যালঘু ১১ ব্যক্তির হত্যার দাবিতে ভুয়া তথ্য প্রচার

১৮

মঞ্চে ‘হকারদের গান’

১৯

ডাম্প ট্রাকচাপায় গৃহবধূ নিহত, অতঃপর...

২০
X