রাখাইনে আর মাত্র তিনটি জায়গা জান্তার নিয়ন্ত্রণে আছে বলে দাবি করেছে মিয়ানমার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইরাবতি নিউজ। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, রাজ্যের রাজধানী শহর সিত্তে, বন্দরনগনরী কিয়াউকফিউ এবং বঙ্গপসাগরীয় দ্বীপাঞ্চল মানাউং জান্তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বাকি ১৪টি শহর দখল করে নিয়েছে আরাকান আর্মি।
সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, প্রায় এক বছরের বিরতির পর আরাকান আর্মি এখন কিয়াউকফিউয়ের জান্তার নৌঘাঁটিতে হামলা শুরু করেছে। একইসঙ্গে তারা আশপাশের সামরিক ফাঁড়ি এবং একটি পুলিশ ব্যাটালিয়নে আক্রমণ চালাচ্ছে। ২০ ফেব্রুয়ারি এই হামলা শুরু হয়েছে।
সামরিক জান্তার শাসন শুরু হওয়ার পর থেকেই মিয়ানমারে অশান্তি শুরু হয়। রাজধানীসহ অন্যান্য শহরে ব্যাপক বিক্ষোভ-প্রতিবাদে জড়ো হয় হাজার হাজার মানুষ। সেসব বিক্ষোভ কঠোরভাবে দমন করে সেনাবাহিনী। জান্তা বাহিনীর গুলিতে মৃত্যু হয় শত শত মানুষের। তবে এখানেই তা থেমে যায়নি।
বহু জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত মিয়ানমারে আগে থেকেই জাতিগত উত্তেজনা চলছিল। রাখাইনের সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি অন্যান্য প্রদেশেও জাতিগত সংখ্যালঘুরা বার্মিজ শাসনের অধীনে কয়েক দশক ধরে বৈষম্যের শিকার হয়েছে। কোনো কোনো প্রদেশে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহও দেখা গিয়েছিল। তেমন একটি প্রেক্ষাপটে জান্তার ক্ষমতা দখল এবং নির্বিচারে গুলি এসব বিদ্রোহীদের দিকেই এগিয়ে দেয় মানুষকে।
মানুষ দলে দলে বিদ্রোহীগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয় তারা। মিয়ানমারে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। দেড় বছরের গৃহযুদ্ধে ইতোমধ্যে অনেকগুলো শহরে জান্তা বাহিনীর পতন ঘটেছে। দেশের ৬০ শতাংশের বেশি এলাকা দখল করে নিয়েছে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। বিশেষ করে বাংলাদেশ লাগোয়া রাখাইনসহ সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলো এখন অনেকটা জান্তার সেনামুক্ত।
জান্তা ক্ষমতা গ্রহণের আড়াই বছরের মাথায় অর্থাৎ ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে দেশটির তিন বিদ্রোহী গোষ্ঠী- তাঙ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), আরাকান আর্মি (এএ) এবং মায়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) জোটবদ্ধ হয়। নতুন এই জোট ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়্যান্স’ নামে সামরিক জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। ওই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন ১০২৭’।
পরবর্তী সময়ে জান্তাবিরোধী এই যুদ্ধে শামিল হয় “চিন ন্যাশনাল আর্মি (সিএনএ), চায়নাল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্স (সিডিএফ), কাচিন লিবারেশন ডিফেন্স ফোর্স (কেএলডিএফ) এবং সুচির সমর্থক স্বঘোষিত সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট-এর সশস্ত্র বাহিনী পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ)।” মায়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি শক্তির স্বঘোষিত সরকার ‘ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট’, জান্তাবিরোধী রাজনৈতিক দল ‘শান স্টেট প্রোগ্রেস পার্টি’ এবং তাদের সশস্ত্র শাখা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থন জানায়।
বিদ্রোহীদের মদদপুষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠী ‘দ্য ইউনাইটেড ওয়া স্টেট পার্টি (ইউডব্লিউএসপি)’ ইতোমধ্যেই কয়েকটি প্রদেশে সমান্তরাল সরকার পরিচালনা শুরু করে দিয়েছে। থাইল্যান্ডে নির্বাসিত মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নাগরিকদের পরিচালিত সংবাদমাধ্যম ‘ইরাবতী’ বিদ্রোহীদের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়েছে জান্তা সরকার। রাজধানী নাইপিদো, প্রধান শহর ইয়াঙ্গন এবং আরও কিছু বড় জনপদ-শিল্পাঞ্চলেই এখন জান্তা বাহিনীর গতিবিধি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিদ্রোহী জোট সে এলাকাগুলো সহজে দখল করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান সামরিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মায়ানমারের রাজধানীসহ বড় জনপদগুলোতে মূলত সংখ্যাগুরু বামার জনগোষ্ঠীর বাস। তাদের বড় অংশই জান্তা সরকারের সমর্থক। প্রভাবশালী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এখনো জান্তার পাশে রয়েছেন। অন্যদিকে, মূলত প্রান্তিক এলাকার জনজাতি গোষ্ঠীগুলো রয়েছে বিদ্রোহীদের জোটে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় শহরগুলোর বাইরে কার্যত পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জান্তা সরকার কতক্ষণ ক্ষমতায় টিকে থাকে সেটাই এখন দেখার বিষয়। অন্যদিকে রাখাইনসহ সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো যদি সম্পূর্ণভাবে বিদ্রোহীরা দখল করে নেয় তাহলে ভেঙে যেতে পারে মিয়ানমার। স্বাধীন রাখাইন নামে বাংলাদেশের পাশে নতুন একটি দেশ তৈরি হতে পারে।
মন্তব্য করুন