কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:২১ পিএম
আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:২৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ওষুধের নামে মাদক পাচার করছে ভারতীয় কোম্পানি

ভারতের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির পরিচালক বিনোদ শর্মা স্বীকার করেছেন, তার কোম্পানি জানে যে এই ওষুধ মানুষের জন্য ক্ষতিকর। ছবি : সংগৃহীত
ভারতের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির পরিচালক বিনোদ শর্মা স্বীকার করেছেন, তার কোম্পানি জানে যে এই ওষুধ মানুষের জন্য ক্ষতিকর। ছবি : সংগৃহীত

ভারতের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি (ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান) আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ওষুধের নামে ভয়ংকর মাদক সরবরাহ করছে। মূলত, কোম্পানিটি এমন একটি ওষুধ তৈরি করছে, যা আসলে মানুষের জন্য ক্ষতিকর এবং এটি নেশার জন্য ব্যবহার করা হয়।

এই মাদকদ্রব্য পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া, ঘানা ও আইভরি কোস্টসহ আরও কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যাভিও ফার্মাসিউটিক্যালস নামে ভারতের মুম্বাইয়ের একটি কোম্পানি এই মাদক উৎপাদন করছে। তাদের তৈরি ওষুধে এমন কিছু উপাদান রয়েছে, যা মানুষের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। আফ্রিকার তরুণরা এই ওষুধকে নেশার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করছে, ফলে তারা আসক্ত হয়ে পড়ছে এবং অনেকেই গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে।

নকল ওষুধের আড়ালে ভয়ংকর মাদক

প্রসঙ্গত, ভারতের অ্যাভিও ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি মূলত এক ধরনের ওষুধ তৈরি করছে, যার মধ্যে ট্যাপেন্টাডল এবং কারিসোপ্রোডল নামক দুটি উপাদান রয়েছে। ট্যাপেন্টাডল হলো এক ধরনের শক্তিশালী ব্যথানাশক, যা মাদকদ্রব্যের মতো কাজ করে। অন্যদিকে, কারিসোপ্রোডল একটি পেশি শিথিলকারী ওষুধ, যা বেশি পরিমাণে গ্রহণ করলে শরীরে ঝিমুনি এবং নেশার অনুভূতি সৃষ্টি করে।

এই দুটি উপাদান একসঙ্গে মিশিয়ে যে ওষুধ তৈরি করা হয়েছে, তা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ‘তাফরোডল’ নামে বিক্রি হচ্ছে। এই মাদক সেবন করলে প্রথমে শরীরে আরামদায়ক অনুভূতি হয়, কিন্তু ধীরে ধীরে এটি মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম নষ্ট করে দেয় এবং আসক্তির সৃষ্টি করে।

গোপন ক্যামেরায় ভারতীয় কোম্পানির স্বীকারোক্তি

বিবিসির অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা এই ওষুধের আসল উৎস খুঁজতে গিয়ে অ্যাভিও ফার্মাসিউটিক্যালসের কারখানার সন্ধান পান। একজন সাংবাদিক আফ্রিকান ব্যবসায়ী সেজে কোম্পানির একজন পরিচালকের সঙ্গে দেখা করেন এবং গোপন ক্যামেরায় তার বক্তব্য রেকর্ড করেন।

ভিডিওতে দেখা যায়, কোম্পানির পরিচালক বিনোদ শর্মা স্বীকার করেছেন, তার কোম্পানি জানে- এই ওষুধ মানুষের জন্য ক্ষতিকর। তিনি বলেন, যদি কেউ একসঙ্গে কয়েকটি ট্যাবলেট খায়, তাহলে সে সম্পূর্ণভাবে আরাম অনুভব করবে এবং নেশার মধ্যে চলে যাবে।

যখন সাংবাদিক জানান, তিনি নাইজেরিয়ার তরুণদের জন্য এই ওষুধ কিনতে চান, তখন বিনোদ শর্মা এতে কোনো আপত্তি জানাননি। বরং তিনি আরও বলেন, এটি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়, তবে এটি একটি লাভজনক ব্যবসা।

আফ্রিকায় মাদকের ভয়াবহ প্রভাব

পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর রাস্তায় সহজেই এই মাদক পাওয়া যাচ্ছে। নাইজেরিয়া, ঘানা ও আইভরি কোস্টের অনেক তরুণ এটি সেবন করে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ঘানা দেশটির তামালে শহরে মাদকের কারণে অনেক তরুণ শিক্ষাজীবন ও স্বাভাবিক জীবন ধ্বংস করে ফেলেছে।

ঘানার একজন মাদকবিরোধী সংগঠনের নেতা আলহাসান মাহাম বলেন, এই মাদক আমাদের তরুণদের ধ্বংস করে দিচ্ছে। যারা একবার এটি গ্রহণ করে, তারা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না।

একজন মাদকাসক্ত তরুণ বলেন, আমি প্রথমে কৌতূহল থেকে এটি খেয়েছিলাম। পরে বুঝতে পারলাম, আমি আর এটি ছাড়া থাকতে পারছি না। এখন আমি কোনো কাজ করতে পারি না, শরীর দুর্বল লাগে।

ভারত থেকে কীভাবে পাচার হয় এই মাদক?

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভারতীয় কোম্পানি ওয়েস্টফিন ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে এই ওষুধ আফ্রিকায় পাঠাচ্ছে। কোম্পানিটি প্রতিবছর কোটি কোটি এই ট্যাবলেট অবৈধভাবে নাইজেরিয়া, ঘানা ও আইভরি কোস্টে সরবরাহ করছে।

নাইজেরিয়ার জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, দেশটিতে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত এবং এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নাইজেরিয়ার মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ বুবা মারওয়া বলেন, এই মাদক আমাদের যুব সমাজকে ধ্বংস করছে। এটি এখন নাইজেরিয়ার প্রতিটি শহরে ছড়িয়ে পড়েছে।

সরকারি ব্যবস্থা ও আইনি পদক্ষেপ

২০১৮ সালে নাইজেরিয়া সরকার ট্রামাডল নামের একটি মাদক জাতীয় ওষুধ নিষিদ্ধ করেছিল। এরপর ভারতীয় কোম্পানিগুলো ট্যাপেন্টাডল ও কারিসোপ্রোডল মিশিয়ে নতুন ওষুধ তৈরি করে বাজারে ছাড়ে, যা আরও বিপজ্জনক।

ভারতের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (সিডিএসসিও) জানিয়েছে, তারা বিষয়টি তদন্ত করছে এবং অভিযুক্ত কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এখনো কোনো বড় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা ও গণপ্রতিরোধ

আফ্রিকার মানুষ নিজেরাই মাদকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। ঘানার তামালে শহরের স্থানীয় বাসিন্দারা মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে আটককৃত তাফরোডল ট্যাবলেট আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে।

ঘানা দেশটির একজন স্থানীয় নেতা বলেন, যদি আমরা কাউকে এই মাদক বিক্রি করতে দেখি, তাহলে তার ওষুধ ধ্বংস করে দেব। আমাদের তরুণদের বাঁচাতে হবে।

উল্লেখ্য, ভারতের কিছু অসাধু কোম্পানি লাভের জন্য আফ্রিকায় বিপজ্জনক মাদক ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা লাখ লাখ তরুণের জীবন নষ্ট করে দিচ্ছে। এ ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হলে ভারত সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং আফ্রিকার দেশগুলোকেও মাদকবিরোধী কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। যতদিন এই অবৈধ ওষুধের সরবরাহ বন্ধ না হবে, ততদিন আফ্রিকার তরুণ সমাজের ভবিষ্যৎ অন্ধকারেই থাকবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কক্সবাজারের বিমান ঘাঁটিতে হামলার বিষয়ে বিস্তারিত জানাল আইএসপিআর

বর্ণাঢ্য আয়োজনে অনুষ্ঠিত গ্লেনরিচের ‘গ্লেনফেস্ট’

আমিরাতে লটারি জিতে কোটিপতি দুই বাংলাদেশি

রামেকে চলছে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি, ভোগান্তি চরমে

দাবি পূরণের আশ্বাস, জবি শিক্ষার্থীর ‘অবস্থান কর্মসূচি’ প্রত্যাহার

কলেজের অধ্যক্ষ পদ নিয়ে সংঘর্ষ, যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

টানা দেড় মাস ছুটি পেতে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা    

সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর গাজীপুরে শিক্ষার্থীদের রেলপথ অবরোধ প্রত্যাহার

‘পদত্যাগ তো পদত্যাগ, অনেকে আমার জানাজাও পড়ে ফেলেছে’

হত্যা করে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানো, ৪ জনের মৃত্যুদণ্ড

১০

‘৬৫ ঘণ্টায় ৭২ ধর্ষণ’, যা জানাল প্রেস উইং 

১১

পোপ ফ্রান্সিসের শারীরিক অবস্থা নিয়ে দুঃসংবাদ

১২

তর্ক-বিতর্ক করতে গিয়ে যেন স্বৈরাচার সুযোগ পেয়ে না যায় : তারেক রহমান

১৩

‘আওয়ামী লীগের ফেরার কোনো সুযোগ নেই’

১৪

কক্সবাজারের বিমান ঘাঁটিতে হামলার বিষয়ে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে : আইএসপিআর

১৫

দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

১৬

‘ধর্ষকের বিচার করতে ব্যর্থ হলে জনগণের হাতে ছেড়ে দিন’

১৭

কুষ্টিয়ায় কালবেলা সাংবাদিকের বাড়ির গাছপালা কাটল দুর্বৃত্তরা

১৮

সন্ধ্যা থেকে সারা দেশে যৌথবাহিনীর টহল

১৯

জার্মানিতে স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা

২০
X