গভীর রহস্যে ঘেরা মহাদেশ আফ্রিকা। এখানে রয়েছে এমন অসংখ্য আদিম জনগোষ্ঠীর বসবাস যারা বহির্বিশ্বের সভ্যতা ও প্রযুক্তির ছোঁয়া থেকে অনেক অনেক দূরে। তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিক দুনিয়ার সংস্কৃতির আকাশ-পাতাল ফারাক। রয়েছে এমন সব রীতিনীতি এবং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যা আধুনিক সমাজের কাছে অস্বাভাবিক বলেই গণ্য হবে। অথচ এগুলিই তাদের কাছে একেবারে স্বাভাবিক ও সামাজিক ভাবে স্বীকৃত।
সেরকমই একটি জনগোষ্ঠী নামিবিয়ার হিম্বা উপজাতি। আধা-যাযাবর উপজাতি বলে বিশ্বের কাছে পরিচিত এরা। মূলত নামিব মরুভূমিতেই বসবাস করেন এই উপজাতির মানুষেরা। জীবনযাত্রা যেমন বৈচিত্র্যে ভরা, তেমনই যৌনতা নিয়েও তাদের রীতিনীতি খুবই অদ্ভুত।
আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য হল অতিথিপরায়ণতা। অতিথিদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বিশেষ নজর দেওয়া হয়ে থাকে এখানে। উত্তর নামিবিয়ার কুনেনে বাস করা হিম্বা উপজাতির মানুষও অতিথিবৎসল। বরং একটু বেশিই, যা আধুনিক সমাজের মানুষ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবেন না। সেখানে অতিথিদের খুশি করতে নিজের স্ত্রীদের অতিথির সঙ্গে রাত্রিযাপনের অনুমতি দেওয়া হয়। আর এই কাজে উৎসাহ দেন স্বামী নিজেই।
এমনকি কোনও নারী যদি অতিথির সঙ্গে মিলনে না-ও রাজি হন তবুও তাকে শারীরিক ভাবে স্পর্শ না করেই অতিথির ঘরে রাত কাটাতে হবে। এই রীতিকে তারা বলেন ‘ওকুজেপিসা ওমুকাজেন্দু’, যার সহজ অর্থ অতিথির কাছে নিজের স্ত্রীকে অর্পণ করে দেওয়া। এই প্রথা চলে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। স্বামীদের সম্মতিতেই এই উপজাতির বিবাহিত নারীরা পর্যটক বা ঘুরতে আসা অতিথিদের সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হন।
হিম্বাদের সমাজে রয়েছে বহুবিবাহের প্রচলন। প্রায় প্রত্যেক মহিলাই সতীনের সঙ্গে সংসার করেন। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে নতুন বৌ ঘরে আনলে তাকে সাদরে বরণ করে নেন প্রথম স্ত্রী। তেমনি মহিলারাও অন্য পুরুষদের সঙ্গে রাত্রী যাপনে বাঁধা দেওয়া হয়না। বরং তাদের সমাজে এটা দোষের কিছু নয়।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, হিম্বা পুরুষদের ৭০ শতাংশেরও বেশি এমন এক সন্তানকে লালন-পালন করেন, যার জন্মদাতা পিতা অন্য পুরুষ। এই উপজাতিতে, বিয়ের বাইরে জন্ম বা বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ককে খোলা মনেই মেনে নেওয়ার রীতি রয়েছে। স্ত্রীর সঙ্গে কোনও অপরিচিত ব্যক্তি বা অতিথি ঘরে রাত কাটালে ঘরের বাইরে স্বামীর রাত কাটানোও সেখানকার সুপ্রাচীন রীতি।
হিম্বা উপজাতির বিয়ের রীতিও অত্যন্ত প্রথাগত এবং ঐতিহ্যবাহী, যা তাদের সমাজের সংস্কৃতি ও জীবনের অঙ্গ। হিম্বা সমাজে বিয়ের আগে বর ও কনের পরিবারের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। সাধারণত, পুরুষকে তার বাগ্দত্তার পরিবারকে কিছু গবাদি পশু (গরু বা ছাগল) প্রদান করতে হয়, যা পুরুষের সামাজিক অবস্থান এবং পরিবারের ক্ষমতা চিহ্নিত করে।
নিজেদের প্রাচীন রীতি থেকে পোশাক, আচার-আচরণ এখানে সবই চলে আসছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। নামিবিয়ার হিম্বা উপজাতির মানুষ এখনও আঁকড়ে রয়েছেন নিজেদের সংস্কৃতি। হিম্বা মহিলারা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেন। রেড আয়রন অক্সাইড, পশুর চর্বি দিয়ে তৈরি এক প্রকার প্রলেপ দিয়ে নিজেদের ত্বক এবং চুল রঙিন করে রাখেন তাঁরা। এই প্রলেপ তাদের ত্বককে রক্ষা করে, আর্দ্রতা বজায় রাখে এবং সুরক্ষিত রাখে।
হিম্বা নারীদের গহনা তাঁদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নারীরা নিজেদের গহনা এবং সাজসজ্জা দিয়ে তাদের ঐতিহ্য, শ্রেণি, এবং সামাজিক অবস্থান প্রকাশ করেন। হিম্বা নারীরা কাঠ, চামড়া, এবং ধাতু দিয়ে তৈরি ব্রেসলেট পরেন। এই ব্রেসলেটগুলো প্রায়শই বিশেষ নকশায় সাজানো হয় এবং একটি সামাজিক প্রতীক হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। অলঙ্কারের মধ্যে গলার হারের উপস্থিতি দেখা যায়, যা চামড়া, রঙিন পাথর দিয়ে তৈরি হয়। এগুলো তাদের সাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং ঐতিহ্যবাহী নকশায় তৈরি হয়।
কুনেনে হিম্বা জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বাস করেন। মূলত পশুপালনই তাদের পেশা। জীবনযাপনের জন্য কৃষিনির্ভর হলেও গবাদি পশু পালন তাদের জীবিকার প্রধান উৎস। পশুপালন, রান্না করা, ঘর গোছানো এবং শিশুদের যত্ন নেওয়ার মতো গৃহস্থালির কাজ করে থাকেন পরিবারের মহিলারাই।
নামিবিয়ার বাকি সমাজ থেকে তুলনামূলকভাবে বিচ্ছিন্ন হিম্বারা। তবে পশ্চিমি সভ্যতার আলোয় ধীরে ধীরে শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হচ্ছেন হিম্বাদের নতুন প্রজন্ম। প্রযুক্তির ব্যবহার, শিক্ষা, জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং বিশ্বায়নের প্রভাব পড়ছে হিম্বাদের উপরেও। বিদেশি পর্যটকদের আগমন, যাঁরা হিম্বাদের সংস্কৃতি দেখতে আসেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে হিম্বাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও।
মন্তব্য করুন