২৬ বছর বয়সী এক তরুণী হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই একদিন নিঃশব্দে বাড়ি ছাড়েন। স্বপ্নের ফ্রান্সের মায়োতি দ্বীপে পৌঁছানোর জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা শুরু করেন। তিনি স্থানীয়ভাবে একটি বিউটি পারলার চালাতেন এবং তার ব্যবসা ভালোই চলছিল। তবে, কেন তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিলেন, তা বুঝে উঠতে পারছে না তার পরিবার।
একদিন ফাতি পরিবারের কাউকেই কিছু না জানিয়ে মায়োতি দ্বীপের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়েন। কিন্তু দুই সপ্তাহ পর তার পরিবারের কাছে মৃত্যুর খবর আসে সেই তরুণীর, যা পরিবারের জন্য এক তীব্র চাপা শোকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ঘটনাটি ঘটেছে সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসুর উপকণ্ঠ ইয়াকশিদ এলাকার ফাতি হুসেইন নামে এক তরুণীর।
ফাতি ইউরোপ যাওয়ার জন্য এমন একটি বিপজ্জনক পথ বেছে নিয়েছিলেন, যা জীবনহানির ঝুঁকি বহন করে। তিনি ভারতের মহাসাগর পাড়ি দিয়ে মায়োতি দ্বীপে পৌঁছানোর জন্য একটি নৌকায় উঠেছিলেন। এই যাত্রায় তিনি অন্যান্য অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সঙ্গে ছিলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন আরও অনেকেই, যারা একই উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলেন।
কিন্তু বিপজ্জনক যাত্রায়, পাচারকারীরা একদিন নৌকা থেকে পালিয়ে যায় ফাতি এবং অন্যদের রেখে। তারপর তারা দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সমুদ্রে ভাসতে থাকে। তাদের খাবার শেষ হয়ে যাওয়ার পর অনাহারে পড়ে অনেকেই মারা যান, তাদের মধ্যে ছিল ফাতি।
ফাতির বোন সামিরা জানান, যারা বেঁচে ফিরেছেন, তাদের কাছ থেকেই আমরা ফাতির মৃত্যুর খবর পাই। তারা জানান, ফাতি অনাহারে থাকতে থাকতে একটা সময় মারা যায়। মৃত্যুর আগে তার স্মৃতি বিভ্রম হয়েছিল এবং মৃত্যুর পর তার মরদেহ সাগরে ফেলে দেওয়া হয়।
এ ঘটনার সময় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ দুটি ছোট নৌকায় করে যাত্রা করছিলেন। কিন্তু, বিপজ্জনক সমুদ্রযাত্রায় ২৪ জনের মৃত্যু হয় এবং ৪৮ জনকে উদ্ধার করা হয়। এই সমস্ত মানুষ মায়োতি দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন, যা মাদাগাস্কারের উত্তর-পশ্চিমে ৩০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
ফাতি ১ নভেম্বর মোগাদিসু থেকে প্রথমে কেনিয়ার মোম্বাসা শহরে পৌঁছান এবং পরে সেখান থেকে নৌকায় মায়োতির দিকে রওনা হন। তার পরিবারের কেউ জানতেন না যে তিনি ইউরোপ যাওয়ার জন্য এমন পরিকল্পনা করছেন।
ছোট বোন সামিরা বলেন, ফাতি আমাদের কাছে বলেছিল যে সে ব্যবসা থেকে সঞ্চিত অর্থ দিয়ে ইউরোপ যাচ্ছিল, তবে সে সাগর পছন্দ করত না। তার এমন সিদ্ধান্ত মানতে পারছি না।
জীবিত উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা জানান, যাত্রা শুরু করার সময় তারা বড় নৌকায় ছিলেন, তবে মাঝপথে পাচারকারীরা তাদের ছোট নৌকায় তোলেন এবং বলেছিলেন, ‘তিন ঘণ্টার মধ্যে মায়োতি পৌঁছাবেন।’ কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, পাচারকারীরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের মাঝপথে ফেলে চলে গিয়েছিল, কারণ তাদের সবার কাছ থেকেই যাত্রার খরচ নেওয়া হয়েছিল।
সামিরা জানান, আটকে পড়ার পর একে একে ১৪ দিন সাগরে ভাসতে থাকা অবস্থায় কেউ তাদের উদ্ধার করেনি। অবশেষে ফাতির মৃত্যু হয়। তিনি আরও বলেন, তারা যে নৌকায় উঠেছিল, তা ছিল স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘কাওসা’ নামে। নৌকা দুটি অত্যন্ত ছোট এবং দুর্গম ছিল।
এ ধরনের বিপজ্জনক পথ দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার প্রচেষ্টা দিন দিন বেড়ে চলেছে, বিশেষ করে মায়োতি দ্বীপে যাওয়ার চেষ্টা। এতে বছরে শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটছে এবং এটি বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক অভিবাসন পথ হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানায়, এই পথটি দিন দিন আরও প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। ২০২৩ সালের প্রথম দিক থেকে এই পথ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আরও বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে বিভিন্ন পাচারকারী চক্র ফেসবুক ও টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইউরোপ যাওয়ার জন্য বিজ্ঞাপন দেয়। এসব বিজ্ঞাপনে নানা ধরনের প্রলুব্ধকর কথা বলে, যা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আকৃষ্ট করে এবং তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ ধরনের বিপজ্জনক যাত্রায় সায় দেয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষকে ধোঁকা দেওয়া হলেও এর ফলস্বরূপ তারা শুধু হতাশ ও শোকসন্তপ্ত হয় না, বরং জীবনও হারায়। পরিবারগুলোর অভিযোগ, পাচারকারীরা বড় নৌকা দেখিয়ে তাদের ছোট নৌকায় উঠায়, যার ফলে এ ধরনের বিপদে পড়তে হচ্ছে।
ফাতির মতো অসংখ্য মানুষ অভিবাসনের এই বিপজ্জনক পথ বেছে নেয়। এ ঘটনা বিশ্বকে আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, অবৈধ অভিবাসনের ক্ষেত্রে জীবনহানির ঝুঁকি প্রচণ্ড।
সূত্র : বিবিসি
মন্তব্য করুন