‘অলৌকিক’ গর্ভধারণের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নারী ও তাদের পরিবারের কাছ থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে ভয়ঙ্কর প্রতারক চক্র। মূলত সন্তান ধারণে ব্যর্থ নারীদের অসহায়ত্বকে টার্গেট করে তারা। চিকিৎসকের বেশে তারা ভুয়া ওষুধ ও ইনজেকশন দিয়ে নারীদের মধ্যে গর্ভধারণের অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করে। এরপর দাবি করে, ভ্রূণটি জরায়ুর বাইরে বেড়ে উঠছে।
প্রতারক চক্রের ভুয়া চিকিৎসকরা নারীদের প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা ‘অলৌকিক চিকিৎসার’ মাধ্যমে গর্ভধারণ করাতে সক্ষম। যেসব নারী তাদের প্রচারকে বিশ্বাস করে চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের সঙ্গে খেলা হয় ভয়ঙ্কর প্রতারণার খেলা।
প্রথম পর্যায়ে নারীদের যৌনাঙ্গে ইনজেকশন ও ওষুধ দিয়ে শরীরে গর্ভবতী হওয়ার উপসর্গ তৈরি করা হয়। এ সময় পেট খানিকটা ফুলে ওঠে, যেন মনে হয় জরায়ুতে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে একটি শিশু। এ সময় তাদেরকে কোনো হাসপাতাল এবং চিকিৎসকের কাছে না যেতে নিষেধ করে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে এটাও বলে দেওয়া হয় যেন তারা আল্ট্রাসোনোগ্রাম না করান।
ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় নারীরা গর্ভধারণের অনুভূতি অনুভব করেন। প্রকৃতপক্ষে তাদের গর্ভে সন্তান নেই কিন্তু তাদের শরীরে কিছু মিথ্যা উপসর্গ তৈরি করা হয়েছে। প্রথমবার চিকিৎসার নেওয়ার সময় একটি বড় অঙ্কের ফি দিতে হয়। এরপর গর্ভধারণের প্রতিটি ধাপ দেখতে হলে নিয়মিত ফি দিয়ে তাদের কাছে যেতে হবে।
এভাবে কারো ক্ষেত্রে ১৫ মাস, আবার কারো ক্ষেত্রে দুই বছর গর্ভধারণের মিথ্যা অনুভূতি দিয়ে প্রতারণা চালিয়ে যাওয়া হয়। এর জন্য নিয়মিত নারীদের বিভিন্ন ওষুধও সেবন করানো হয় যাতে উপসর্গগুলো বজায় থাকে।
যখন প্রসবের সময় হয়, তখন বিশেষ ওষুধ দেওয়ার নামে আরও বেশি অর্থ দাবি করে প্রতারক চক্র। এই ভুয়া প্রসবের সময় নারীদের অ্যানেস্থেশিয়ার মাধ্যমে অজ্ঞান করে সেখানে সংগৃহীত একটি নবজাতককে এনে দেওয়া হয়, যাকে ঐ নারীর গর্ভজাত সন্তান বলে বিশ্বাস করানো হয়।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির আফ্রিকা আই টিম এ ভয়ঙ্কর প্রতারণা নিয়ে তাদের অনুসন্ধান চালিয়েছে। বিবিসি বলছে, এমন সব ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটছে আফ্রিকা মহাদেশের নাইজেরিয়ার আনামব্রা রাজ্যে। দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ক্যারিবিয়ান অঞ্চল, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে সক্রিয় একই ধরনের বহু প্রতারক চক্র।
গোপন তথ্যের ভিত্তিতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নাইজেরিয়ার আনামব্রা রাজ্যের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এমন একটি অবৈধ ক্লিনিকে অভিযান চালায়। সেখানে বেশ কয়েকজন গর্ভবতী নারীকে জোরপূর্বক আটকে রাখা হয় এবং তাদের সদ্যজাত শিশুকে এই চক্র ওই সব নিঃসন্তান দম্পতির কাছে দিয়ে দেয়। প্রসবের সময় যখন গর্ভধারণের মিথ্যা অনুভূতি দেওয়া নারীদের অজ্ঞান করা হয় তখন এসব থেকেই একটি শিশুকে এনে ওই নারীর জন্ম দেওয়া সন্তান হিসেবে রাখা হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অভিযানে উদ্ধারকৃত নারীদের মধ্যে অনেকে আর্থিক চাপে পড়ে বা ভয় পেয়ে এই চক্রে যুক্ত হন বলে জানান। বিশেষজ্ঞদের মতে, নারীদের প্রতি সামাজিক চাপ, বন্ধ্যাত্বের প্রতি কুসংস্কার এবং প্রজনন অধিকার নিয়ে সঠিক ধারণার অভাব এসব প্রতারণা চালিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
এ ধরনের ঘটনা রোধে নারীদের সচেতনতা বাড়ানো এবং সমাজে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। তারা জানান, এ ধরনের প্রতারণা শুধু সামাজিক চাপে থাকা নারীদের দুঃখকেই বাড়িয়ে তোলে না, বরং মানব পাচারের মতো ভয়াবহ অপরাধের পথও বিস্তৃত করে।
মন্তব্য করুন