যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ের পর হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার প্রক্রিয়ায় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার দ্বিতীয় মেয়াদে প্রশাসন গঠন ও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ব্যাপক পরিকল্পনা দেশ-বিদেশে আলোচনা সৃষ্টি করেছে। মনে করা হচ্ছে, এ কার্যক্রম শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতিতে নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
নির্বাচনের পরপরই ট্রাম্প তার মন্ত্রিসভা এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক টিম গঠনে মনোযোগী হয়েছেন। ইতোমধ্যে তিনি কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে দায়িত্বও দিয়েছেন, যারা তার প্রশাসনের মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করবেন।
দায়িত্ব প্রাপ্তদের মধ্যে সাবেক কংগ্রেসওম্যান এবং কট্টর ট্রাম্প সমর্থক তুলসি গ্যাবার্ডকে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। তার নিয়োগ ট্রাম্প প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা নীতিতে দৃঢ় অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়। এ ছাড়া সরকারি কার্যক্রমে দক্ষতা বাড়াতে ইলন মাস্ক ও বিবেক রামাস্বামীকে নতুনভাবে গঠিত ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট ইফিশিয়েন্সি (ডোজ) এই বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ইলন মাস্ক ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় বিশাল অর্থ সহায়তা দেওয়ায় তাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়রকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেছেন ট্রাম্প, যিনি স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সর্বশেষ ট্রাম্প তার প্রশাসনে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি পদে ২৭ বছর বয়সী ক্যারোলিন লেভিতকে মনোনয়ন দিয়েছেন।
এদিকে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে কংগ্রেসের উভয় কক্ষে রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণ ট্রাম্পের ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ এক্ষেত্রে আইন পাশ এবং নীতি বাস্তবায়নের পথে ট্রাম্পের সামনে বাধা কম থাকবে। তবে সিনেটে রিপাবলিকানদের নেতৃত্ব নিয়ে কিছু অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। ট্রাম্পের সমর্থিত প্রার্থী সিনেটের নেতা হিসেবে নির্বাচিত না হওয়ায় কিছু বাধার সম্ভাবনা রয়েছে। মনে করা হচ্ছে, ট্রাম্প মনোনীত কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দলের মধ্য থেকে বিরোধিতা হতে পারে, যা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বিলম্ব ঘটাতে পারে।
মার্কিন অভিবাসন নীতিতে নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প শক্ত অবস্থান প্রকাশ করেছেন। যা প্রশাসনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণ সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প এবং অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়নের ঘোষণা দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে ট্রাম্পের এই নীতি বাস্তবায়নে আইনি এবং লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হতে পারে। এর অর্থনৈতিক প্রভাবও যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি ও সেবাখাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
শুল্ক বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় টাম্প চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি এবং অন্যান্য বিদেশি পণ্যে শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং নিত্যপণ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলেছেন। শুল্ক বৃদ্ধির ফলে মার্কিন ভোক্তাদের ওপর ব্যয়ভার বাড়তে পারে, যা ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্প তার প্রচারণায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করবেন। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিশেষ করে রাশিয়ার বিষয়ে ট্রাম্পের অবস্থান কিছুটা নমনীয়। তার পরিকল্পনা সমঝোতার মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধ করা, যা ইউক্রেনের ওপর মার্কিন সহায়তা হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়। তবে, মধ্যপ্রাচ্য সংকটে গাজার ওপর ইসরায়েলের ওপর হামলা বিষয়ে ইসরায়েলের দৃঢ় সমর্থক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন ট্রাম্প। যা মধ্যপ্রাচ্যে তার নীতিতে ভারসাম্যের অভাব দেখা যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্যান্য অঞ্চলে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান করলেও মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে ইসরায়েলকে সমর্থন তার সামগ্রিক নীতিতে দ্বৈততা তৈরি করেছে। গাজায় যুদ্ধ থামানোর জন্য নেতানিয়াহুর কাছে আবেদন জানালেও ট্রাম্পের অবস্থান ইসরায়েলের পক্ষেই থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া লেবাননের হিজবুল্লাহ সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ থামানোর পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছেন ট্রাম্প।
নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প পরিবেশ সংরক্ষণ নীতিতে কাটছাঁট করার ঘোষণা দিয়েছেন। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো এবং ইলেকট্রিক গাড়ির প্রচলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় ওই সব কোম্পানীর কাছ থেকে তহবিলও সংগ্রহ করেছেন এই অবস্থান নেওয়া কথা বলে। পরিবেশবাদী গোষ্ঠীগুলো তার এই নীতির তীব্র সমালোচনা করেছে।
ট্রাম্পের যে সব সমর্থক হোয়াইট হাউসে হামলা ও দাঙ্গার সঙ্গে জড়িত তাদের ক্ষমা ও আইনি সমস্যার সমাধান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায়। এ ছাড়া ট্রাম্পের বিরুদ্ধে থাকা ফৌজদারি মামলাগুলো দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেবেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
চীন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্ত অবস্থান নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন ট্রাম্প। যার ফলে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও শীতল হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার মনোনীত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্ক রুবিও চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
সর্বপরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে তার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি এবং বৈশ্বিক স্থিতিশীলতায় ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। ট্রাম্পের সাহসী এবং বিতর্কিত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রবণতা তার প্রশাসনকে একটি নতুন দিক দিতে পারে। তবে, এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আইনগত, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা তার জন্য কঠিন হবে।
মার্কিন নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতিগুলো যদি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন ধরনের শাসনব্যবস্থা দেখা যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এর ব্যর্থতা দেশটির অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অবনতিরও কারণ হতে পারে।
মন্তব্য করুন