মোট বাজেটের এক তৃতীয়াংশ নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য উন্নয়নে খরচ হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জেন্ডার বাজেট মোট বাজেটের ৩৪.১১ শতাংশ অর্থাৎ ২ লাখ ৭১ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা নারী উন্নয়নের বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেন্ডার বাজেট মোট বাজেটের ৩৪.০৯ শতাংশ অর্থাৎ ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব ছিল। জেন্ডার বাজেট এবার বেড়েছে মোট বাজেটের মাত্র .০২ শতাংশ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে পরিচালন বাজেট ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা পরিচালন বাজেটের প্রায় ৩২.৫৩ শতাংশ । ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিচালন বাজেট ছিল ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে । যা পরিচালন বাজেটের প্রায় ৩২.০১ শতাংশ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেট ১ লাখ ৬ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ৩৭.৯৪ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেট ১ লাখ ২ হাজার ১৮২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল। যা উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ৩৬.৮১ শতাংশ। ৪৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এই টাকা খরচ করেছে। গত দেড় দশকের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, টাকার অঙ্কে নারীর উন্নয়নে বা জেন্ডার বাজেট প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। তবে বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ খরচ হয়েছে নারীর উন্নয়নে। বাকি বিপুল অঙ্কের এই টাকার পুরোটাই নারীর উন্নয়নে খরচ হয়েছে কি না তা নিয়ে ধোঁয়াশা থেকে গেছে। বাজেট বরাদ্দ ও বণ্টনের ক্ষেত্রে সঠিক রূপরেখা মেলেনি। অন্যদিকে নারীর ক্ষমতায়নে ঋন সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
বিশ্বের তুলনায় দেশে নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি মন্থর। নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে ২০২৪-২৫ এ বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৬৪ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৬০ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ৮ শতাংশ ও ৮.৫ শতাংশ। চলতি বাজেটের চেয়ে .৫ শতাংশ কম। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ এবং সমতায় ২০২৪-২৫ এ বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৭৬ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৬৬ হাজার ১৮ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ৯.৬ ও ৯.২ শতাংশ। চলতি বাজেটের চেয়ে .৪ শতাংশ বেশি। কার্যকর সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে নারীর সুযোগ বৃদ্ধিতে ২০২৪-২৫ এ বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৪৪ হাজার ৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৪১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ৫.৫ শতাংশ ও ৫.৭ শতাংশ। চলতি বাজেটের চেয়ে ২ শতাংশ কমেছে। নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কল্যাণে ২০২৪-২৫ এ বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৮৬ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৭০ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ১০.৯ শতাংশ ও ৯.৮ শতাংশ। চলতি বাজেটের চেয়ে ১.১ শতাংশ বেড়েছে।
জেন্ডার বাজেট খরচের পর কোথায় নারী ক্ষমতায়নে কতটুকু উন্নতি হলো এবং পরবর্তীতে কী করা হবে তা নিয়ে কোনও পর্যালোচনা দেখা যায়নি। নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি কীভাবে বাড়ল; উৎপাদন, শ্রমবাজার ও আয়বর্ধক কাজে নারীর অধিক অংশগ্রহণ কতটুকু নিশ্চিত হলো এবং সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে নারীর সুযোগ বৃদ্ধির কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তারও কোন সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
জেন্ডার বাজেট যেখানে পুরো বাজেটের ৩৪.০৯ শতাংশ ছিল, নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাজেটের বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপের অভাব চিহ্নিত করেছেন বিশ্লেষকরা। এই অর্থ বছরের জেন্ডার বাজেট পুরো বাজেটের ৩৪.১১ শতাংশ করা হয়েছে। মাত্র .০২ শতাংশ বেড়েছে।
এদিকে চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) তথ্য ঘেটে দেখা যায়- মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়-এর নেওয়া ১৪টি প্রকল্পের মধ্যে মাত্র ৩টি প্রকল্প সরাসরি নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সাথে সম্পৃক্ত। হাওড় এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত নারীর আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, কর্মজীবী মায়েদের শিশু সন্তানদের জন্য ৬৪ জেলায় ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন, ৬৪ জেলায় কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল নির্মাণ। অন্যদিকে শিশুদের জন্য ৪ বছর বয়সী শিশুদের জন্য শিশু বিকাশ কেন্দ্র স্থাপন, গ্রামীণ শিশুদের সৃজনশীল কাজ সংগ্রহ এবং প্রদর্শন, নিরাপদ ইন্টারনেট নিরাপদ শিশু কর্মসূচি বাস্তবায়ন ইত্যাদি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য ৫ হাজার ২২২ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা ছিল ৪ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা।
তবে প্রতিবেদনে কিছু খাতের বরাদ্দকে নারীর উন্নয়ন হিসেবে দেখিয়েছে যা অবান্তর মনে হয়েছে। যেমন – বহুমুখী পাটজাত পণ্য উৎপাদন বিষয়ক উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদান, নারী ভোটারের ডেটাবেজ তৈরি, মিরপুর ও মালিবাগে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য অবকাঠামো তৈরি এবং গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর বরাদ্দকেও জেন্ডার বাজেটে দেখানো হয়েছে।
এছাড়া তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ সুবিধাবঞ্চিত নারীদের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ব্যবসা, জেন্ডার ও আইনি সহায়তাসহ দৈনন্দিন সমস্যা সমাধান, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে সহায়তা, সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে। এতে প্রশ্ন ওঠে , নারী উন্নয়ন কি শুধু উন্নয়ন-কর্মশালা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ? নাকি এটি নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, বাল্যবিয়ে রোধের মতো কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সমান বরাদ্দ? এই জায়গায় স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন। প্রান্তিক এলাকাতেও যখন নারী উন্নয়নে সমবণ্টন থাকবে তখন নারীর প্রতি সহিংসতাসহ জেন্ডারভিত্তিক সমস্যাসমূহ থাকবে না।
জেন্ডার বাজেটের উপযুক্ত ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলোকে আরও নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। আইনের আশ্রয়প্রার্থী নারীর খরচ, সহিংসতার শিকার নারীদের সহায়তা প্রদান, জেন্ডার সহিংসতা রোধে সার্বিক পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ, সন্তান লালন-পালনে সহায়তা প্রদান এবং বাল্যবিবাহ বন্ধে কিশোরীর পড়াশোনার ব্যয়ের মতো বিষয়গুলো জেন্ডার বাজেটের পরিকল্পনায় আওতাভুক্ত করা যেতে পারে।
ন্যায্যতার ভিত্তিতে বরাদ্দ অর্থের কার্যকরী বিনিয়োগ ও সুষ্ঠু ও বণ্টন নিশ্চিত করা, এবং ভবিষ্যতে সকলকে সাথে নিয়ে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য কমিয়ে আনতে বাজেট ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, জেন্ডার বাজেট শুধু নারীর জন্য আলাদা কোনো বাজেট নয়, বরং এটি এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় হিসাব-নিকাশের সাহায্যে জাতীয় বাজেটের জেন্ডার-সংবেদনশীলতা বিশ্লেষণ করা যায়। এই বাজেটের যথাযথ বরাদ্দ ও সুষ্ঠু বণ্টনের মাধ্যমে পুরো দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক প্রগতি নিশ্চিত হবে।